১৯৩৬ সালে জন্মগ্রহণকারী এই পরমাণু বিজ্ঞানী দক্ষিণ এশিয়ার দেশটির পারমাণবিক বোমা তৈরির জন্য বড় ভূমিকা রেখেছেন। ২০২১ সালে ৮৫ বছর বয়সে মারা যাওয়া এই বিজ্ঞানী কঠোর গোপনীয়তা রক্ষা করে এমন পারমাণবিক কর্মসূচি তৈরি করেছিলেন যার আনুষ্ঠানিকভাবে বিশ্বের কাছে কোন অস্তিত্ব ছিল না।
শুধু পাকিস্তানেই নয় তিনি ইরান, লিবিয়া এবং উত্তর কোরিয়াকে তাদের পারমাণবিক কর্মসূচিতে সহায়তা করার জন্যও আরও বিস্তৃত গোপন নেটওয়ার্ক চালাতেন। আরেক পরমাণু শক্তিধর দেশ ইসরায়েল পাকিস্তানকে তাদের পরমাণু কর্মসূচি থেকে বিরত রাখতে গুপ্তহত্যার চেষ্টা ও হুমকি দিয়েছিল বলে অভিযোগ রয়েছে।
আশির দশকে ভারতের সহায়তায় পাকিস্তানের পরমাণু স্থাপনায় বোমা ফেলার পরিকল্পনাও করে ইসরায়েল। তবে তাদের কোন পরিকল্পনা সফল হয়নি। এবং পাকিস্তান পারমাণবিক শক্তিতে পরিণত হয়।
শুরুটা হয়েছিল ১৯৭৪ সালের ১৮ মে। যখন ভারত প্রথম পরমাণু অস্ত্রের পরীক্ষা চালিয়েছিল। সেসময় পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলি অবিলম্বে তার নিজের দেশের জন্য পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির অঙ্গীকার করেন।
পাকিস্তানিরা এ কিউ খানকে এখনও গর্বের সাথে স্মরণ করে। কেননা তিনিই ছিলেন পাকিস্তানের পারমাণবিক বোমা তৈরির পেছনের একমাত্র কারিগর। ১৯৭৪ সালে খান আমস্টারডামের বড় পারমাণবিক জ্বালানী সংস্থা ইউরেনোতে সাব-কন্ট্রাক্টর হিসেবে কাজ করছিলেন। সেসময় তিনি পারমাণবিক কর্মসূচির প্রধান গোপনীয় অঞ্চল এবং বিশ্বের শীর্ষ সেন্ট্রিফিউজের ব্লুপ্রিন্টগুলো দেখার সুযোগ পান। সেখানে এমন সেন্ট্রিফিউজ ছিল যা প্রাকৃতিক ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করে এবং এটিকে বোমা তৈরির জ্বালানীতে পরিণত করে।
১৯৭৬ সালের জানুয়ারিতে তিনি নেদারল্যান্ডস থেকে আকস্মিক ও রহস্যজনকভাবে প্রস্থান করেন। এসময় তিনি জানান, পাকিস্তান থেকে তাকে এমন একটি প্রস্তাব দেয়া হয়েছে যা প্রত্যাখ্যান করা তার পক্ষে সম্ভব নয়। পরে খানের বিরুদ্ধে ইউরেনিয়াম সেন্ট্রিফিউজের ব্লুপ্রিন্ট চুরি করে পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়ার অভিযোগ আনা হয়।
সে বছরের জুলাইয়ে তিনি পাকিস্তানের রাওয়াল পিন্ডিতে একটি গবেষণা পরীক্ষাগার স্থাপন করেন। সেখানে তিনি পারমাণবিক অস্ত্রের জন্য সমৃদ্ধ ইউরেনিয়ামের উত্পাদন শুরু করেন। পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী খানের এই গবেষণা কাজকে সমর্থন করলেও তৎকালীন পাকিস্তান সরকারকে সেসময় রাখা হয় একদম অন্ধকারে।
এমনকি প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টোর সাথেও জেনারেলরা ইরানের সাথে পারমাণবিক প্রযুক্তি ভাগাভাগি কর্মসূচি সম্পর্কে একটি শব্দও বলেননি। ১৯৮৯ সালে তেহরানে দুর্ঘটনাবশত তিনি বিষয়টি জানতে পারেন। যখন ইরানের প্রেসিডেন্ট তাকে একপাশে নিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করেন, তারা বিশেষ প্রতিরক্ষা বিষয়ে দুই দেশের পরমাণু সমঝোতা পুনর্ব্যক্ত করতে পারবে কিনা।
পরমাণু অভিযানের পেছনে এ কিউ খানের প্রেরণা ছিল অনেকাংশে আদর্শগত। তবে এই কর্মসূচিকে বানচাল করার গুরুতর প্রচেষ্টা শুরু হয়। যার মধ্যে ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের তৎপরতা ব্যাপকভাবে চোখে পড়ে। যারমধ্যে একাধিক হত্যার প্রচেষ্টা অন্তর্ভুক্ত ছিল।
এমনকি ইউরোপীয় সংস্থাগুলোর যে নির্বাহীরা খানের সাথে কাজ করেছেন তারাও লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হলো। পাকিস্তানের পরমাণু কর্মসূচি নিয়ে কাজ করা সুইস কোম্পানি কোরা ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের এক জ্যেষ্ঠ নির্বাহীকে লক্ষ্য করে বোমা হামলা চালানো হয়।
এমনকি ১৯৮০ এর দশকের গোড়ার দিকে ইসরায়েল রাওয়াল পিন্ডিতে থাকা পারমাণবিক স্থাপনায় বোমা হামলা ও ধ্বংস করার জন্য ভারতকে প্রস্তাব দেয়। ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী এই অভিযানের অনুমোদন দেন। ভারতের গুজরাটের একটি বিমানঘাঁটি থেকে পাকিস্তানি স্থাপনায় হামলা চালানোর জন্য ইসরায়েলি বোমারু বিমান উড্ডয়নের পরিকল্পনা করা হয়।
তবে গান্ধী পরে পিছু হটে যান এবং পরিকল্পনাটি স্থগিত করা হয়। ভারত ও ইসরায়েলের বিরোধিতা সত্ত্বেও অ্যামেরিকানরা পাকিস্তানের পরমাণু কর্মসূচি নিয়ে মুখ বন্ধ করে রেখেছিল। এর অন্যতম কারণ সেসময় পাকিস্তান ছিল অ্যামেরিকার স্নায়ুযুদ্ধের গুরুত্বপূর্ণ মিত্র।
কিন্তু স্নায়ুযুদ্ধের অবসানের সাথে সাথে সবকিছু বদলে যায়। ১৯৯০ সালের অক্টোবরে অ্যামেরিকা পরমাণু কর্মসূচির প্রতিবাদে পাকিস্তানকে অর্থনৈতিক ও সামরিক সহায়তা বন্ধ করে দেয়। তখন পাকিস্তান বলেছিল, তারা পরমাণু অস্ত্র তৈরি বন্ধ করবে। পরে অবশ্য এ কিউ খান জানান, গোপনে এই অভিযান অব্যাহত রাখা হয়।
এরপর ১৯৯৮ সালে পাকিস্তান নিজেদের পরমাণু ওয়ারহেডের সফল পরীক্ষা চালায়। খান হয়ে ওঠেন জাতীয় বীর। রাস্তাঘাট, স্কুল এমনকি ক্রিকেট দলও তার নামে নামকরণ করা হয়। তবে তিনি আরও একটি দুঃসাহসী অভিযানের পরিকল্পনা করেন।
১৯৮০ এর দশকের মাঝামাঝি থেকে খান একটি আন্তর্জাতিক পারমাণবিক নেটওয়ার্ক পরিচালনা করেন যা ইরান, উত্তর কোরিয়া এবং লিবিয়ায় প্রযুক্তি এবং নকশা সরবারহ করে। মধ্যপ্রাচ্যে ঘুরে বেড়ানোর সময় মোসাদ তাকে নজরদারিতে রাখলেও এই বিজ্ঞানী ঠিক কী করছেন তা বুঝতে ব্যর্থ হয়।
মোসাদ প্রধান শাবাই শ্ভিত পরে বলেছিলেন যে তিনি যদি খানের উদ্দেশ্য বুঝতে পারতেন তবে তিনি তাকে হত্যার আদেশ দেয়ার বিষয়টি বিবেচনা করতেন। শেষ পর্যন্ত লিবিয়ার স্বৈরশাসক মুয়ামার গাদ্দাফি ২০০৩ সালে অ্যামেরিকার সমর্থন আদায়ের চেষ্টা করতে গিয়ে খানের পারমাণবিক কর্মসূচির কথা প্রকাশ করে দেন।
গাদ্দাফি সিআইএ এবং এমআই সিক্স এর কাছে স্বীকার করেন যে খান লিবিয়ান সরকারের জন্য পারমাণবিক সাইট তৈরি করছিলেন। যার মধ্যে কয়েকটি মুরগির খামারের আড়ালে তৈরি করা হচ্ছিল। এরপরেই সিআইএ সুয়ারেজ খাল দিয়ে লিবিয়াগামী পাচারকৃত যন্ত্রপাতি জব্দ করে এবং অস্ত্র উদ্ধার করে। এসময় তদন্তকারীরা ইসলামাবাদের ড্রাই ক্লিনারের ব্যাগে থাকা ব্লুপ্রিন্ট জব্দ করে।
২০০৪ সালে খান স্বীকারোক্তি দেন তবে তিনি বলেন, পাকিস্তান সরকারের কোন সমর্থন ছাড়াই একাই এ কাজ করেছিলেন তিনি। পরবর্তীতে অ্যামেরিকার চাপের মুখে পাকিস্তান সরকার ২০০৯ সাল পর্যন্ত খানকে ইসলামাবাদে গৃহবন্দি করে রাখে। খান পরে তার এক বক্তব্যে বলেন, পাকিস্তানকে পরমাণু শক্তিধর দেশ বানিয়ে প্রথমবারের মতো আমি আমার দেশকে বাঁচিয়েছি। পরবর্তীতে যখন স্বীকারোক্তি দিয়ে পুরো দোষ নিজের ওপর চাপিয়েছিলাম তখন আবারও দ্বিতীয়বারের মতো আমি নিজেই দেশকে বাঁচিয়েছি।
মৃত্যুর দু'বছর আগে ২০১৯ সালে খান প্রকাশ্যে বলেছিলেন, পাকিস্তান একটি নিরাপদ পরমাণু শক্তিধর দেশ হিসেবে নিশ্চিন্তে থাকতে পারে কেননা কোন অপশক্তি পাকিস্তানের ওপর কু নজর দিতে পারবে না।