৪ আগস্ট, ২০২৪, বীরোচিত উত্তরার এ যাবৎকালের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় সংঘর্ষের দিন ছিল আজ, যা দ্বিতীয় স্বাধীনতার ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে।
গত বছরের আজকের এই দিনে প্রায় পুরোটা দিন সকাল থেকে শুরু করে রাত অবধি সংঘর্ষ চলতে থাকে। ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগ সবাই মিলে শেষ মরণ কামড়টা দেয় এবং শেষে রাষ্ট্রীয় বাহিনীগুলোও যোগ দেয় সে হত্যাযজ্ঞে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অসহযোগ ও সরকার পতনের এক দফা দাবিতে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের সঙ্গে তৎকালীন সরকারপন্থী নেতা-কর্মীদের সংঘর্ষ দিনভর চলতে থাকে। সেদিন ছিল রোববার, ১২টার দিকে উত্তরা আজমপুর এলাকায় সংঘর্ষের সূত্রপাত ঘটে।
বেলা ১১টার দিকে উত্তরার বিভিন্ন এলাকা থেকে ছোট-ছোট মিছিল নিয়ে উত্তরা বিএনএস টাওয়ারের সামনে জড়ো হয় আন্দোলনকারীরা। তারা বিএনএস থেকে উত্তরা পূর্ব থানা পর্যন্ত সড়ক দখল করে বিক্ষোভ করতে থাকে। পরে ১২টার দিকে আজমপুরের রাজউক কমার্শিয়াল ভবনের সামনে সরকার দলীয় নেতা-কর্মীদের সঙ্গে সংঘর্ষ শুরু হয়। বিশেষ করে সাবেক এমপি হাবিব হাসানের সঙ্গের লোকজন প্রকাশ্যে অস্ত্র দিয়ে এলোপাথাড়ি গুলি করে। সে গুলিতে শেষ পর্যন্ত তিনজন শহীদ হন এবং অসংখ্য লোক আহত হয়।
গুলিবিদ্ধদের স্থানীয় কুয়েত মৈত্রী, বাংলাদেশ মেডিকেল ও ক্রিসেন্ট হাসপাতালে পাঠানো হয় বলে জানান আন্দোলনকারীরা। ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সালেহ মাহমুদ রায়হান নামে এক আন্দোলনকারী বলেন, ‘হঠাৎ আজমপুর দুই নম্বর রোড দিয়ে ছাত্রলীগ-যুবলীগের লোকজন এসে ভারী অস্ত্র দিয়ে আমাদের ওপর গুলি চালায়।’ এদিকে উত্তরা পূর্ব থানার সামনে প্রচুর পরিমাণে পুলিশ সদস্য মোতায়েন থাকলেও তাদের নীরব ভূমিকায় দেখা গেছে। তবে ১২টার দিকে পুলিশ কয়েকটি সাউন্ড গ্রেনেড ছোড়ে বলে জানান আন্দোলনকারীরা। বিজয়ের আগের দিন ৪ আগস্ট দুপুরে উত্তরার আজমপুর বাসস্ট্যান্ড রবীন্দ্র সরণির মুখে বনফুল মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের সামনে গুলিবিদ্ধ হন ইতিহাদ এয়ারলাইন্সের কর্মকর্তা মাহমুদুর রহমান খান সোহেলসহ বেশ কয়েকজন বিক্ষোভকারী। রাজপথে তাঁর নিথর দেহ পড়ে থাকতে দেখা যায়। যে ছবিটা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের শীর্ষ সংবাদে পরিণত হয়। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে ততক্ষণে তাঁর অনেক ক্ষতি হয়ে যায়। কিন্তু অনবরত গুলির মুখে সহযোদ্ধারা তাঁর কাছে যেতে পারছিল না।
ঘটনাস্থলে উপস্থিত বস্ত্র প্রকৌশলী ও জুলাই রেভুলেশনারি অ্যালায়েন্স‘র উপদেষ্টা তালহা জুবায়ের বলেন, ‘সকাল সাড়ে ১০টার দিকে আজমপুরের আমীর কমপ্লেক্সের সামনে সাবেক সংসদ সদস্য হাবীব হাসানসহ আওয়ামী লীগের ১০-১৫ জন নেতাকর্মী ছিলেন। আমি একা তখন পরিস্থিতি দেখতে গিয়েছিলাম। ওই সময় ছাত্ররা বিএনএস সেন্টারের সামনে জড়ো হন। এরপর তারা ধাওয়া দিলে আওয়ামী লীগের লোকজন গুলি ছুড়তে-ছুড়তে পালিয়ে যায়। তবে এর কিছুক্ষণ পরই সাথিলসহ অস্ত্রধারী একটি দল ফ্রেন্ডস ক্লাব মাঠের দিক থেকে এগিয়ে আসে। আপডেট টাওয়ারের দিক থেকে আসে আরেক দল। দুই দলকেই ধাওয়া দেয় ছাত্ররা। এতে ওরা কিছুটা পিছিয়ে যায়। এর পর সাথিল গুলি ছুড়তে-ছুড়তে এগিয়ে আসেন। সামনেই ছিলেন ইতিহাদ এয়ারওয়েজের কার্গো শাখার বিক্রয় ব্যবস্থাপক মাহমুদুর রহমান খান সোহেল। তাঁকে কাছ থেকে গুলি করেন সাথিল। মাহমুদ ভাই লুটিয়ে পড়েন। এরপর তারা আরও এগিয়ে আসে। রবীন্দ্র সরণিতে কামারপাড়া হাইস্কুলের দশম শ্রেণির ছাত্র আব্দুল্লাহ আল মাহিনকে গুলি করলে সেও লুটিয়ে পড়ে। তাদের মধ্যে মাহমুদ ভাই চিকিৎসাধীন অবস্থায় ৯ আগস্ট এবং মাহিন সেদিনই মারা যায়।
তখন হেলমেট পরা সাথিলের পরিচয় জানতে পারিনি। পরে খোঁজ নিয়ে পরিচয় নিশ্চিত হওয়া গেছে। আমরা অনেক ঝুঁকি নিয়ে সোহেল ভাইয়ের দেহটা কোনোমতে বাংলাদেশ মেডিকেলে নিয়ে যাই। পুরো আন্দোলনে তাঁকে আমরা পাশে পেয়েছি। তিনি শিক্ষার্থীদের জন্য বিভিন্ন রকম খাদ্যদ্রব্য নিয়ে আসতেন। আমরা আশ্চর্য হয়ে যেতাম, এরকম উচ্চবিত্ত পরিবারের একজন মানুষ সব ছেড়ে জনতার কাতারে এসে দাঁড়িয়েছেন। সেদিন আনারুল ইসলাম নামে এক সবজি ব্যবসায়ীও সাথিলের গুলিতে আহত হন বলে জানান প্রত্যক্ষদর্শীরা। ৬ আগস্ট তাঁর মৃত্যু হয়।’
সারাদেশের মতো উত্তরার আন্দোলনেও আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে। সেটা হলো সাংবাদিকরা পুলিশের এ সমস্ত অপকর্ম লাইভ ভিডিও অথবা ছবি তোলার কারণে তারাও অন্যতম টার্গেটে পরিণত হন। সাংবাদিক দেখলেই পুলিশ সাংবাদিকদের দিকে সরাসরি গুলি ছুড়তে থাকে। ওইদিনের সার্বিক বিষয়ে কথা হয় দৈনিক সমকালের নিজস্ব প্রতিবেদক ইয়াসির আরাফাতের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘আমাদের সঙ্গে যুগান্তরের প্রতিবেদক ছিলেন দেলোয়ার হোসেন। হঠাৎ দেখি তিনি কাঁদছেন। আসলে যাদের বাচ্চা আছে, তারা কোনোভাবেই আর নিতে পারছিলেন না। আন্দোলনে এগুলো দেখে আসলে আমরা নিজেদের ধরে রাখতে পারিনি। একটা পরিবারকে দেখেছিলাম, বাবা-মা ছেলে-মেয়ে চারজন এসেছেন রাস্তায়। পুরো পরিবার নেমে এসেছে বাচ্চাদের পাশে। আর পুলিশের কথা কি বলবো? পুলিশের টার্গেট থেকে নিজেদের রক্ষা করাও অন্যতম একটা চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। কারণ ইতোমধ্যে চারজন সাংবাদিক শহীদ হয়েছেন পুলিশের গুলিতেই।’
নিউজটি আপডেট করেছেন : Kaler Diganta
উত্তরার ইতিহাসে আজ ছিল সবচেয়ে বড় সংঘর্ষের দিন
- আপলোড সময় : ০৪-০৮-২০২৫ ০৬:০২:০৪ অপরাহ্ন
- আপডেট সময় : ০৪-০৮-২০২৫ ০৬:০৯:৫৯ অপরাহ্ন

কমেন্ট বক্স
সর্বশেষ সংবাদ