লেখক: ইরফান ইবনে আমিন পাটোয়ারী, শিক্ষার্থী, প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
১৯৬৪ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর টাঙ্গাইল জেলার কালিহাতী উপজেলার পাইকরা ইউনিয়নের গোলরা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন অধ্যাপক ড. আইয়ুব খান। শৈশব থেকেই মেধাবী এই শিক্ষার্থী শিক্ষা জীবনের প্রতিটি পর্যায়ে অসামান্য সাফল্য অর্জন করেন।
১৯৭৯ সালে তিনি আইসড়া উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট (এসএসসি) এবং ১৯৮১ সালে সরকারি সাদত কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক সার্টিফিকেট (এইচএসসি) পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে উচ্চশিক্ষার জন্য ভর্তি হন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগ থেকে স্নাতক সম্পন্ন করার পর স্নাতকোত্তর পর্যায়েও প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান অর্জন করে অসামান্য মেধার স্বাক্ষর রাখেন।
উচ্চশিক্ষা শেষে তিনি বেশ কিছুদিন আহসান মঞ্জিল জাদুঘরে কর্মরত ছিলেন। কিন্তু জাদুঘরের চাকরির সীমাবদ্ধ গণ্ডি তাঁর বিস্তৃত জ্ঞানচর্চা ও শিক্ষাদানের অভিলাষ পূরণ করতে পারেনি। ফলে তিনি শিক্ষকতার পেশায় যুক্ত হয়ে আজীবনের অধ্যাপনা জীবনের যাত্রা শুরু করেন।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগে যোগদানের মাধ্যমে তিনি শিক্ষা ও গবেষণার এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেন। দীর্ঘ শিক্ষকতা জীবনে তিনি ধাপে ধাপে অধ্যাপক পদে আসীন হন এবং সর্বশেষ প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের বিভাগীয় প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
শিক্ষাদান ও গবেষণা; এই দুইয়ের প্রতি সমানভাবে নিবেদিতপ্রাণ ছিলেন তিনি। তাঁর লেখা ইতিহাস বিষয়ক বিভিন্ন গ্রন্থ শিক্ষার্থীদের মাঝে বিশেষভাবে জনপ্রিয়। শুধু পাঠ্যবই নয়, গবেষণাধর্মী বিভিন্ন প্রবন্ধ, নিবন্ধ ও প্রবন্ধ সংকলনের মাধ্যমে তিনি প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণা, ইতিহাসচর্চা এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অজানা দিক উন্মোচনে অবদান রেখেছেন।
দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ও গবেষণায় তাঁর রচিত গ্রন্থ ও প্রবন্ধ ব্যাপকভাবে ব্যবহার হচ্ছে। জাতীয় জ্ঞানকোষ বাংলাপিডিয়ার বিভিন্ন নিবন্ধেও তাঁর লেখা যুক্ত হয়েছে, যা নতুন প্রজন্মের গবেষকদের জন্য নির্ভরযোগ্য তথ্যসূত্র হিসেবে কাজ করছে।
দেশ-বিদেশের অসংখ্য সেমিনার, কর্মশালা ও সম্মেলনে তিনি প্রবন্ধ উপস্থাপন করেছেন। এর মাধ্যমে বাংলাদেশের প্রত্নতত্ত্ব ও ইতিহাস চর্চাকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পরিচিত করানোর ক্ষেত্রে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। তাঁর গবেষণা মূলত বাংলার ইতিহাস, প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন, প্রাচীন স্থাপত্য সহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আবর্তিত হলেও, তিনি সর্বদা বিস্তৃত দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিষয়গুলো বিশ্লেষণ করতেন, যা তাঁর কাজকে গভীর ও অনন্য করে তুলেছে।
তবে গবেষক কিংবা শিক্ষক হিসেবেই নয়, ড. আইয়ুব খান ছিলেন মানবিক গুণাবলির এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। সদা হাস্যোজ্জ্বল, সহজ-সরল ও ছাত্র-শিক্ষক-সহকর্মীদের প্রতি অগাধ ভালোবাসাপূর্ণ আচরণের কারণে তিনি ছিলেন সবার প্রিয়। শ্রেণিকক্ষে তাঁর পাঠদানের ধরণ ছিল প্রাণবন্ত ও শিক্ষার্থীবান্ধব। কঠিন কোনো বিষয়কেও সহজভাবে উপস্থাপন করার ক্ষমতা তাঁকে একজন জনপ্রিয় শিক্ষক হিসেবে অনন্য মর্যাদায় আসীন করেছে।
তাঁর প্রয়াণ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় তথা বাংলাদেশের প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণার অঙ্গনে এক অপূরণীয় ক্ষতি। তাঁর মৃত্যুর মধ্য দিয়ে কেবল একজন শিক্ষক বা গবেষককেই হারাতে হয়নি, হারাতে হয়েছে এক জীবন্ত অনুপ্রেরণাকে। তিনি আজ আমাদের মাঝে নেই, কিন্তু তাঁর কর্ম, তাঁর লেখা, তাঁর গবেষণা এবং তাঁর স্মৃতি আজও প্রত্নতত্ত্ব বিভাগে, তাঁর শিক্ষার্থী-সহকর্মী ও শিক্ষকদের হৃদয়ে বেঁচে আছে।
অধ্যাপক ড. আইয়ুব খান আজীবন যে বোধ, মমতা ও জ্ঞানের চর্চা করে গেছেন, তা নতুন প্রজন্মের প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষক ও শিক্ষার্থীদের অনুপ্রেরণা জোগাবে। তিনি আমাদের সকলকে যে জ্ঞানের আলো দিয়ে ঋণী করে গেছেন, তা কোনোদিন শোধ হওয়ার নয়। তাঁর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা।
নিউজটি আপডেট করেছেন : Kaler Diganta
প্রয়াত অধ্যাপক ড. আইয়ুব খান – প্রত্নতত্ত্ব ও ইতিহাসের অনন্য নক্ষত্র
- আপলোড সময় : ২৯-১০-২০২৫ ১০:৫৪:৫৩ অপরাহ্ন
- আপডেট সময় : ২৯-১০-২০২৫ ১০:৫৭:৪৭ অপরাহ্ন
ছবি স্বত্বঃ লেখক
কমেন্ট বক্স
সর্বশেষ সংবাদ
ডেস্ক রিপোর্ট