বৈষম্য ও বঞ্চনার অভিযোগে যখন সিলেটে আন্দোলন ও আলটিমেটাম চলছে, ঠিক সেই সময়ে এলো আরেক দুঃসংবাদ—সুরমার ওপর পরিকল্পিত ঝুলন্ত সেতু (হ্যাংগিং ব্রিজ) আর হচ্ছে না। পরিবর্তে শতবর্ষী কীন ব্রিজের সংস্কার ও ‘সক্ষমতা বৃদ্ধি’র পরিকল্পনা নিচ্ছে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর (সওজ)। এ সিদ্ধান্তে সিলেটজুড়ে হতাশা ও ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে।
একসময় কীন ব্রিজই ছিল সুরমা নদী পারাপারের প্রধান মাধ্যম। কিন্তু বয়সের ভারে ন্যুব্জ এই ঐতিহাসিক সেতু এখন ভারী যান চলাচলের অযোগ্য। তাই দীর্ঘদিন ধরে সিলেটবাসী আশায় ছিলেন—ব্রিজের পাশে একটি আধুনিক ঝুলন্ত সেতু হবে, যা শহরের যানজট কমাবে এবং পর্যটনে যোগ করবে নতুন মাত্রা।
বিদেশি উন্নয়ন সংস্থা নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এনডিবি) প্রস্তাবিত ৩০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের বিনিয়োগে সেতুটি নির্মাণে আগ্রহ দেখালেও, “অ্যাপ্রোচ সড়কের জায়গা নেই”—এই যুক্তিতে প্রকল্পটি বাতিল করেছে সওজ। যদিও এনডিবি ২০২৪ সালের জানুয়ারিতেই সেতুর সম্ভাব্য স্থান পরিদর্শন, নদীর নাব্যতা ও পানিপ্রবাহের জরিপ শেষ করেছিল, ৫ আগস্টের রাজনৈতিক অস্থিরতার পর প্রকল্পের অগ্রগতি থেমে যায়।
পরবর্তীতে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় জানায়, সুরমার দুই পাড়ে জায়গা সংকট থাকায় ঝুলন্ত সেতু নির্মাণ সম্ভব নয়। তাই পুরনো কীন ব্রিজের কাঠামো সংরক্ষণ ও সীমিতভাবে যান চলাচল সক্ষমতা বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। সওজ সিলেটের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আমীর হোসেন বলেন, “নতুন ঝুলন্ত সেতুর জন্য উভয় পাশে দীর্ঘ অ্যাপ্রোচ রোড দরকার। জায়গা না থাকায় প্রকল্পটি বাস্তবায়ন সম্ভব হচ্ছে না।”
কিন্তু সিলেটবাসীর প্রশ্ন—শতবর্ষী কীন ব্রিজের সংস্কারই কি আধুনিক সিলেটের যোগাযোগ চাহিদা পূরণ করবে? তাদের দাবি, প্রশাসনিক অজুহাতে বারবার উন্নয়ন প্রকল্প বাতিলের ধারাবাহিকতা সিলেটকে ক্রমেই পিছিয়ে দিচ্ছে।
স্থানীয় নাগরিক সংগঠন, ব্যবসায়ী ও পেশাজীবীরা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, “আরেকটি উন্নয়ন স্বপ্ন কাগজেই শেষ হলো।”
জেলা বিএনপি সভাপতি আব্দুল কাইয়ুম চৌধুরী বলেন, “সিলেটবাসীর বঞ্চনা ও বৈষম্য একই সূত্রে গাঁথা। সিলেট জেগে উঠছে, এবার হিসাব চাওয়া শুরু হবে।”
সিলেট টোয়াস সাধারণ সম্পাদক শেখ রাফি মনে করেন, “ঝুলন্ত সেতুটি হলে শহরের সৌন্দর্য ও পর্যটন সম্ভাবনা নতুনভাবে উজ্জ্বল হতো। অথচ সেই স্বপ্ন হারিয়ে গেল প্রশাসনিক ফাইলে।”
সিলেট সোসাইটির উপদেষ্টা ডা. জহির অচিনপুরী প্রশ্ন রাখেন, “সিলেটের উন্নয়ন প্রকল্প গোপনে বাতিল কেন করা হলো? সওজকে এ বিষয়ে গণমাধ্যমের সামনে ব্যাখ্যা দিতে হবে।”
সিটিজেন রাইটস লইয়ার্স এলায়েন্সের কনভেনর অ্যাডভোকেট মঈনূল হক বুলবুল বলেন, “সিলেটবাসী নিজেদের অধিকারের ব্যাপারে যতটা উদাসীন ছিল, এখন ধীরে ধীরে জেগে উঠছে। এই হিসাব তোলার সময় আর বেশি দূরে নয়।”
সচেতন মহলের অভিযোগ, একের পর এক উন্নয়ন প্রকল্পে সিলেটকে উপেক্ষা করা যেন এখন অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। কখনো বিমানবন্দর সম্প্রসারণ থেমে যায়, কখনো রেললাইন ডাবলিং প্রকল্প ঝুলে থাকে, আবার কখনো বন্দর ও হাওর উন্নয়ন প্রকল্প হারিয়ে যায় রাজনৈতিক টানাপোড়েনে। এবার ঝুলন্ত সেতু প্রকল্প বাতিল হয়ে সেই তালিকায় যুক্ত হলো নতুন হতাশার অধ্যায়।