ধূমপান একটি বৈশ্বিক জনস্বাস্থ্য সংকট, যার শিকার কেবল ধূমপায়ী ব্যক্তি নয়, বরং সমাজ ও পরিবেশও। এটি একটি নেশা সংক্রান্ত অভ্যাস, যা দীর্ঘমেয়াদে ব্যক্তির শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর গুরুতর প্রভাব ফেলে। ধূমপানজনিত রোগে প্রতি বছর বিশ্বে লক্ষ লক্ষ মানুষ প্রাণ হারায়।
তামাকজাত দ্রব্যের ব্যবহারের ফলে জন্ম নেয় এমন সব জটিলতা, যা শুধু স্বাস্থ্য খাতেই নয়, বরং অর্থনীতি ও সামাজিক কাঠামোতেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। এই আলোচনায় ধূমপানের বৈজ্ঞানিক প্রভাব এবং এর সমাজতাত্ত্বিক দিকগুলোর একটি বিশ্লেষণ উপস্থাপন করা হবে, সমসাময়িক গবেষণা ও পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) তথ্যমতে, প্রতি বছর বিশ্বে প্রায় ৮০ লক্ষ মানুষ ধূমপানের কারণে মৃত্যুবরণ করে, যার মধ্যে প্রায় ১২ লক্ষ মানুষ প্যাসিভ স্মোকিং বা পরোক্ষ ধূমপানের শিকার। তামাকজাত পণ্য ব্যবহারের কারণে ক্যান্সার, হৃদরোগ, স্ট্রোক, ফুসফুসের রোগসহ বহু অসুস্থতা সৃষ্টি হয়।
বিজ্ঞানসম্মত গবেষণায় দেখা যায়, ধূমপানে ব্যবহৃত তামাক পাতায় প্রায় ৭০০০ রাসায়নিক উপাদান থাকে, যার মধ্যে ৭০টিরও বেশি উপাদান ক্যান্সার সৃষ্টি করতে সক্ষম।
ধূমপানের ফলে ফুসফুসের কোষে জিনগত পরিবর্তন ঘটে, যা ধীরে ধীরে ক্যান্সারে রূপ নেয়। নিয়মিত ধূমপান রক্তনালির সংকোচন ঘটায়, ফলে উচ্চ রক্তচাপ ও হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ে। গর্ভবতী নারীরা যদি ধূমপান করেন বা পরোক্ষ ধূমপানের পরিবেশে থাকেন, তাহলে গর্ভস্থ শিশুর জন্মগত ত্রুটি, কম ওজন এবং এমনকি মৃত সন্তান প্রসবের ঝুঁকি বৃদ্ধি পায়। শিশুরা যদি ধূমপানের পরিবেশে বেড়ে ওঠে, তবে তাদের মধ্যে শ্বাস-প্রশ্বাসের জটিলতা, হাঁপানি এবং ভবিষ্যতে ধূমপানের প্রবণতা দেখা যায়।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে পরিসংখ্যান আরও উদ্বেগজনক। বাংলাদেশ তামাক ব্যবহারের উচ্চ হারের একটি দেশ হিসেবে পরিচিত। "গ্লোবাল অ্যাডাল্ট টোব্যাকো সার্ভে (GATS) ২০১৭" অনুসারে, বাংলাদেশে প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে প্রায় ৩৫.৩% কোনো না কোনোভাবে তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার করে। এর মধ্যে ৩৭.৫% পুরুষ এবং ২৪.৮% নারী তামাক ব্যবহার করে।
প্রতি বছর প্রায় ১ লাখ ২৬ হাজার মানুষ তামাকজনিত রোগে মারা যায়। ধূমপান কেবল শহরাঞ্চলে সীমাবদ্ধ নয়; গ্রামীণ অঞ্চলগুলোতেও এর বিস্তার লক্ষণীয় এবং তরুণদের মধ্যেও ধূমপানের হার বেড়েই চলেছে।
সমাজতাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে ধূমপান একটি সাংস্কৃতিক ও মনস্তাত্ত্বিক চর্চায় পরিণত হয়েছে। অনেক তরুণ ধূমপানকে প্রভাব, আধুনিকতা কিংবা মানসিক চাপ থেকে মুক্তির প্রতীক হিসেবে বিবেচনা করে। মিডিয়া, বন্ধু-প্রভাব এবং সহজলভ্যতা ধূমপানকে তরুণদের কাছে আরও গ্রহণযোগ্য করে তুলেছে।
তবে ধূমপানের সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব অনস্বীকার্য। নিম্ন আয়ের মানুষের একটি বড় অংশ তামাকজাত দ্রব্যের পেছনে অর্থ ব্যয় করে প্রয়োজনীয় খাদ্য, শিক্ষা বা চিকিৎসার পেছনে ব্যয়ের পরিবর্তে। ফলে একটি পরিবার অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে এবং দারিদ্র্য চক্রে আটকে যায়। পাশাপাশি, ধূমপানের কারণে কর্মক্ষমতা হ্রাস পায় এবং স্বাস্থ্য সেবার ব্যয় বৃদ্ধি পায়, যা সামগ্রিকভাবে জাতীয় অর্থনীতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করে।
সরকার ও বেসরকারি সংস্থাসমূহ তামাক নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে, যেমন পাবলিক প্লেসে ধূমপান নিষিদ্ধ, তামাকজাত পণ্যে স্বাস্থ্য সতর্কীকরণ চিত্রের ব্যবহার, বিজ্ঞাপনে নিয়ন্ত্রণ আরোপ ইত্যাদি। কিন্তু বাস্তবতায় অনেক ক্ষেত্রেই এসব আইনের প্রয়োগ দুর্বল, এবং জনগণের সচেতনতার অভাবে এই পদক্ষেপগুলো কার্যকরভাবে বাস্তবায়িত হচ্ছে না।
সার্বিকভাবে দেখা যায়, ধূমপান একটি বহুমাত্রিক সমস্যা, যা কেবল স্বাস্থ্যগত নয়, বরং সামাজিক, অর্থনৈতিক ও মনস্তাত্ত্বিক দিক থেকেও গভীরভাবে প্রভাব বিস্তার করে। এই সমস্যা মোকাবেলায় কেবল আইনি পদক্ষেপই যথেষ্ট নয়; প্রয়োজন শিক্ষা, সচেতনতা, এবং সামাজিক মূল্যবোধের পরিবর্তন।
তরুণ প্রজন্মকে ধূমপানের ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে অবহিত করে, স্বাস্থ্যকর জীবনধারায় উদ্বুদ্ধ করাই হতে পারে একটি ধূমপানমুক্ত সমাজ গঠনের প্রথম পদক্ষেপ।
একটি সুস্থ, সচেতন ও দারিদ্র্যমুক্ত সমাজ গঠনে ধূমপানের বিরুদ্ধে সম্মিলিত পদক্ষেপ গ্রহণ এখন সময়ের দাবি। গবেষণাভিত্তিক নীতিনির্ধারণ, আইনের বাস্তবসম্মত প্রয়োগ এবং শিক্ষা ও সচেতনতা বৃদ্ধিই পারে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে তামাকের ভয়াল ছোবল থেকে রক্ষা করতে।
লেখক: ইরফান ইবনে আমিন পাটোয়ারী, শিক্ষার্থী, প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
নিউজটি আপডেট করেছেন : Kaler Diganta
ধূমপানের পরিসংখ্যান ও প্রভাব: বৈজ্ঞানিক এবং সমাজতাত্ত্বিক বিশ্লেষণ
- আপলোড সময় : ০৭-১০-২০২৫ ০১:০৪:২৭ পূর্বাহ্ন
- আপডেট সময় : ০৭-১০-২০২৫ ০১:০৪:২৭ পূর্বাহ্ন

কমেন্ট বক্স
সর্বশেষ সংবাদ