যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের ঘোষণা অনুযায়ী আগামীকাল ১ আগস্ট থেকে বাংলাদেশের পণ্য রফতানিতে ৩৫ শতাংশ পাল্টা শুল্কহার কার্যকর হবে। যদিও ওয়াশিংটনে পাল্টা শুল্ক নিয়ে চলমান তৃতীয় দফা আলোচনার প্রথম দিন শেষে প্রতিনিধিত্ব করা বাংলাদেশের সরকারি কর্তাব্যক্তিরা আলোচনায় শুল্কহার নিয়ে ‘ভালো কিছু’র আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের পোশাক ক্রেতাপ্রতিষ্ঠান প্রতিনিধিরা ভবিষ্যতে বাংলাদেশ থেকে ক্রয় বৃদ্ধির ক্ষেত্রে ট্রাম্প প্রশাসনের বাণিজ্য বিধিনিষেধকে প্রতিবন্ধকতা বলে মনে করছেন। এক সমীক্ষা প্রতিবেদনে তাদের উদ্বেগের তথ্য উঠে এসেছে।
ওয়াশিংটন ডিসির বাংলাদেশ দূতাবাস জানিয়েছে, মঙ্গলবার বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র শুল্ক ইস্যু নিয়ে তৃতীয় ধাপের আলোচনা আনুষ্ঠানিক শুরু হয়েছে। এদিন যুক্তরাষ্ট্রের স্থানীয় সময় বেলা ২টায় শুরু হয়ে বৈঠক চলে বিকাল সাড়ে ৫টা পর্যন্ত। গতকাল দ্বিতীয় দিনের বৈঠক শুরু হয় ওয়াশিংটন সময় সকাল ৯টায়।
বৈঠকে অংশ নেয়া বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন। প্রতিনিধি দলে আরো আছেন প্রধান উপদেষ্টার জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ও রোহিঙ্গা বিষয়ক হাই রিপ্রেজেন্টেটিভ ড. খলিলুর রহমান, বাণিজ্য সচিব মাহবুবুর রহমান ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব ড. নাজনীন কাওসার চৌধুরী। দুদিনের বৈঠকেই বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও দপ্তরের কর্মকর্তারা ঢাকা থেকে ভার্চুয়ালি অংশ নিয়েছেন। প্রথম দিনের আলোচনায় যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে নেতৃত্ব দেন সহকারী ট্রেড রিপ্রেজেন্টেটিভ ব্রেন্ডন লিঞ্চ। তার সঙ্গে ছিলেন বাণিজ্য ও শুল্কসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
দ্বিতীয় দিনের বৈঠক শুরুর আগে প্রথম দিনের বৈঠকের ফলাফল জানতে চাইলে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘ভালো একটা ফলাফলের উদ্দেশ্যেই আমরা আলোচনা করছি। আলোচনা শেষ হলে চূড়ান্ত ফলাফল জানতে পারব।’ তবে বৈঠকে অংশ নেয়া সরকারের আরেক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা গতকাল বলেন, ‘বাংলাদেশের ওপর আরোপ করা ৩৫ শতাংশ শুল্ক কমবে এমন ইঙ্গিত যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে দেয়া হয়েছে।’
প্রথম দুই দফার আলোচনায় যুক্তরাষ্ট্র থেকে আরো বেশি পণ্য আমদানির মাধ্যমে বাণিজ্য ঘাটতি কমিয়ে আনাসহ বেশকিছু বাণিজ্যিক বাধ্যবাধকতা-সংক্রান্ত শর্ত দিয়েছিলেন দেশটির কর্মকর্তারা। বাস্তবতার প্রেক্ষাপটে সব শর্ত মানা সম্ভব না হলেও যুক্তরাষ্ট্র থেকে বেশকিছু পণ্য আমদানির মাধ্যমে বাণিজ্য ঘাটতি কমিয়ে আনা সম্ভব। যার অংশ হিসেবে দেশটি থেকে গম, তুলা, এলএনজি ও উড়োজাহাজ কেনার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের উড়োজাহাজ নির্মাতা প্রতিষ্ঠান বোয়িংকে প্রাথমিকভাবে ২৫টি ওয়াইড বডি উড়োজাহাজ কেনার প্রস্তাবও দিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। যুক্তরাষ্ট্রের দেয়া চুক্তির প্রাথমিক প্রস্তাবের জবাবে এসব প্রস্তাব বাংলাদেশের পক্ষ থেকে দেয়া হয়েছে। যার ওপর ভিত্তি করে তৃতীয় দফা আলোচনা শুরু হয়েছে।
এদিকে আলোচনায় অংশ নেয়া বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধিরা শুল্ক কমার বিষয়ে ‘ভালো কিছু’র আশাবাদ ও ইতিবাচক ইঙ্গিতের কথা বললেও বাংলাদেশের ওপর সম্ভাব্য বাণিজ্যিক বিধিনিষেধের শঙ্কা প্রকাশ করেছেন খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পোশাক ক্রেতাপ্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরা। তাদের এ মনোভাবে উদ্বেগ জানিয়েছেন বাংলাদেশের পোশাক সরবরাহকারী রফতানিকারকরা। উল্লেখ্য, যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের মোট পণ্য রফতানির ৮৭ শতাংশই তৈরি পোশাক।
গত মঙ্গলবার ‘২০২৫ ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রি বেঞ্চমার্কিং স্টাডি’ শীর্ষক জরিপ প্রতিবেদন প্রকাশ পেয়েছে। ইউনিভার্সিটি অব ডেলাওয়ারের ফ্যাশন অ্যান্ড অ্যাপারেল স্টাডিজ বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ড. শেং লুর তত্ত্বাবধানে জরিপটি পরিচালিত হয়। সহযোগিতায় ছিল যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সংগঠন ইউনাইটেড স্টেটস ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রি অ্যাসোসিয়েশন (ইউএসএফআইএ)। ২০১৪ সালে শুরু হওয়া জরিপ প্রতিবেদনের দ্বাদশ সংস্করণ প্রকাশ পেয়েছে গত ২৯ জুলাই। যুক্তরাষ্ট্রে ফ্যাশন পণ্য বাজারজাতকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর যেসব নির্বাহী পোশাক ক্রয়ের দায়িত্বে নিয়োজিত, তাদের দেয়া বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তরের ভিত্তিতে জরিপ প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে। যেখানে বিভিন্ন দেশের পোশাক শিল্প সম্পর্কে তাদের পর্যবেক্ষণ ও মতামত উঠে এসেছে। জরিপে শীর্ষস্থানীয় ৩০টি মার্কিন ফ্যাশন ব্র্যান্ড, খুচরা বিক্রেতা, আমদানিকারক এবং পাইকারি প্রতিষ্ঠানের নির্বাহীদের মতামত নেয়া হয়েছে, যার মধ্যে অনেকগুলোই দেশটির সবচেয়ে বড় ব্র্যান্ড ও খুচরা বিক্রেতা।
জরিপ প্রতিবেদনে বাংলাদেশের বিষয়ে বলা হয়েছে, প্রায় ৫৩ শতাংশ উত্তরদাতা আগামী দুই বছরে বাংলাদেশ থেকে পোশাক সোর্সিং বাড়ানোর আগ্রহ দেখিয়েছেন। ২০২৪ সালের জরিপে এ হার ছিল ৪৮ শতাংশ। ২০২৫ সালের প্রথম পাঁচ মাসে যুক্তরাষ্ট্রের মোট পোশাক আমদানির প্রায় ১০ দশমিক ৬ শতাংশ এসেছে বাংলাদেশ থেকে, যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল ৯ দশমিক ২ শতাংশ।
তবে ব্যয় সাশ্রয়ের সুবিধা থাকলেও বাংলাদেশ থেকে পোশাক সংগ্রহ এখনো সামাজিক ও পরিবেশগত কমপ্লায়েন্সের দিক দিয়ে তুলনামূলকভাবে উচ্চ ঝুঁকির বিবেচনায় পড়ে বলে জানিয়েছেন জরিপে অংশগ্রহণকারীরা। উত্তরদাতারা উদ্বেগ প্রকাশ করে জানিয়েছেন, ভবিষ্যতে বাংলাদেশের পোশাক রফতানি যুক্তরাষ্ট্রে নতুন বাণিজ্য বিধিনিষেধের মুখে পড়তে পারে। এর পেছনে সম্ভাব্য দুটি কারণ চিহ্নিত করেছেন ক্রেতাপ্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরা। এগুলো হলো যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের বাড়তে থাকা বাণিজ্য উদ্বৃত্ত এবং বস্ত্র ও পোশাকের কাঁচামালের ক্ষেত্রে চীনের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরতা। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এ উদ্বেগ যুক্তরাষ্ট্রের ফ্যাশন কোম্পানিগুলোকে পোশাক ক্রয়ের উৎসকে বৈচিত্র্যময় করতে চীননির্ভরতা কমানোর প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ থেকে সোর্সিং উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়ানো থেকে পিছিয়ে রাখছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ট্রাম্পের নতুন নীতির প্রভাবে ২০২৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ফ্যাশন কোম্পানিগুলো ব্যাপক চাপে রয়েছে। জরিপে অংশ নেয়া ৭০ শতাংশেরও বেশি উত্তরদাতা জানিয়েছেন, সামগ্রিকভাবে বাড়তি শুল্ক তাদের ওপর উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলেছে। সোর্সিং খরচ বেড়েছে, মুনাফার পরিমাণ কমেছে, ভোক্তা পর্যায়ে পণ্যের দাম বেড়েছে। প্রায় ৫০ শতাংশ প্রতিষ্ঠান বিক্রি কমার কথা জানিয়েছে। ২২ শতাংশ প্রতিষ্ঠান এরই মধ্যে কর্মী ছাঁটাই করেছে। দুই-তৃতীয়াংশের বেশি প্রতিষ্ঠান অর্ডার স্থগিত বা বাতিল করেছে। অনেকে শুল্কের খরচ সরবরাহকারীদের ভাগ করে নেয়ার জন্য চাপ দিচ্ছে, যা অনেক ছোট সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানকে ব্যবসা গুটিয়ে ফেলার ঝুঁকিতে ফেলেছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) নির্বাহী সভাপতি ফজলে শামীম এহসান বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তৃতীয় দফার আলোচনা থেকে চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত এখনো জানা যায়নি। আশা করছি আলোচনা শেষে ফলাফল ভালোর দিকেই যাবে। কারণ দেশটি থেকে পণ্য ক্রয় বৃদ্ধির মাধ্যমে ঘাটতি কমানোর প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে। ঝুঁকিপূর্ণ হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশ বোয়িং ক্রয়ের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। সবকিছু মিলিয়ে এ আলোচনা ভালো কিছু নিয়ে আসবে বলেই আশা করছি।’
ক্রেতারা বাংলাদেশ থেকে পোশাক ক্রয় বাড়াতে চান, কিন্তু বাণিজ্যিক বিধিনিষেধ নিয়ে মার্কিন ক্রেতাদের আশঙ্কা প্রসঙ্গে ফজলে শামীম এহসান বলেন, ‘ট্রাম্পের নতুন ঘোষণার পর এরই মধ্যে ক্রেতারা চাপ দিয়ে অনৈতিকভাবে পণ্যের দাম কমিয়ে নিচ্ছেন। ক্রেতার নকশা অনুযায়ী বাংলাদেশের পোশাক রফতানিকারকরা পণ্য প্রস্তুত করেন। গোটা শিল্পই ক্রেতানির্ভর। বাংলাদেশে তৈরি হয় না এমন কোনো কাপড় দিয়ে ক্রেতা যদি পোশাক বানাতে বলেন তাহলে আমাদের বাধ্য হয়েই চীন বা অন্যান্য উৎস থেকে কাপড় সংগ্রহ করতে হয়। ফলে ক্রেতারা নকশা করার সময় যদি কাঁচামালের ক্ষেত্রে চীননির্ভরতা কমানোর বিষয়টি বিবেচনায় নেন তাহলে স্বাভাবিকভাবেই বিধিনিষেধ আরোপের ঝুঁকি কমে আসবে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের রফতানিকারকদের তেমন কিছু করার নেই।’
দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় বসার পর গত ২ এপ্রিল শতাধিক দেশের ওপর উচ্চহারে পাল্টা শুল্ক (রেসিপ্রোকাল ট্যারিফ) আরোপের ঘোষণা দেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। বাংলাদেশের ওপর বাড়তি ৩৭ শতাংশ শুল্কের ঘোষণা আসে। এ নিয়ে উদ্বেগের মধ্যে বাংলাদেশসহ অনেক দেশই শুল্ক কমাতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দেনদরবার শুরু করে। কোনো কোনো দেশ মার্কিন পণ্যের ওপর শুল্কহার শূন্যের ঘরে নামিয়ে আনার ঘোষণা দেয়। এর এক সপ্তাহের মাথায় গত ৯ এপ্রিল বাড়তি শুল্ক ৯০ দিনের জন্য স্থগিত করেন ট্রাম্প, যার মেয়াদ শেষ হয়েছে। তবে তার আগেই গত ৮ জুলাই বাংলাদেশী পণ্যের ওপর নতুন শুল্ক আরোপের ঘোষণা দিয়ে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে চিঠি পাঠান ডোনাল্ড ট্রাম্প। চিঠিতে তিনি বলেছেন, ‘আগামী ১ আগস্ট থেকে যুক্তরাষ্ট্রে পাঠানো বাংলাদেশী সব পণ্যের ওপর ৩৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হবে।’
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তির বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে, দ্বিপক্ষীয় আলোচনা যদি শুধু শুল্কের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকত, তাহলে বিষয়গুলো অনেক সহজ হতো। কিন্তু দরকষাকষি শুধু শুল্ক নিয়ে নয়, এর চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যপূর্ণ চুক্তিতে থাকা বাণিজ্যিক বাধ্যবাধকতাবিষয়ক শর্ত। যা পুরো বিষয়টির জটিলতা বাড়িয়ে দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের দেয়া বাধ্যবাধকতা আবার অনেক ক্ষেত্রেই বাংলাদেশের অর্থনীতির সক্ষমতার বাইরে। এমনকি সেগুলো দেশের অভ্যন্তরীণ অর্থনীতিকেও ক্ষতিগ্রস্ত করবে।
সূত্র আরো জানায়, দরকষাকষির আলোচনাটি শুল্কের চেয়েও বেশি বাণিজ্য বিধিমালাবিষয়ক। এমনকি সেগুলো শুধু বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কেন্দ্রিকও না। অনেকগুলো মন্ত্রণালয় ও খাতসংশ্লিষ্টদেরও এর সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ার বিষয় রয়েছে। বাণিজ্যবিষয়ক কিছু শর্ত একেবারেই অগ্রহণযোগ্য বলেও মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। এসব বিবেচনায় যুক্তরাষ্ট্রের শর্ত বাংলাদেশের পক্ষে মেনে নেয়া প্রায় অসম্ভব।
এ প্রেক্ষাপটে বেশকিছু বিষয় অমীমাংসিত রেখে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বিতীয় দফা আলোচনা শেষ হয়। গত মঙ্গলবার থেকে শুরু হয়েছে তৃতীয় দফার আলোচনা।