গতকাল ভোরে আঘাত হানা এ ভূমিকম্প ১০০ বছরের মধ্যে অন্যতম শক্তিশালী ভূকম্পন হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
রাশিয়ার পূর্ব উপকূলের কামচাটকা উপদ্বীপে ৮ দশমিক ৮ মাত্রার এক শক্তিশালী ভূমিকম্প আঘাত হেনেছে। গতকাল ভোরে আঘাত হানা এ ভূমিকম্প ১০০ বছরের মধ্যে অন্যতম শক্তিশালী ভূকম্পন হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। কম্পনের প্রভাবে প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলজুড়ে কমপক্ষে ১৮টি দেশ ও বিভিন্ন অঞ্চলে সুনামি সতর্কতা জারি করা হয়েছে। প্রাথমিকভাবে প্রাণহানির খবর পাওয়া না গেলেও উপকূলীয় এলাকায় বসবাসকারী লাখ লাখ মানুষকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেয়া হয়েছে। কয়েকটি দ্বীপপুঞ্জে সুনামির ঢেউ এরই মধ্যে আছড়ে পড়েছে বলে জানিয়েছে স্থানীয় প্রশাসন ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো।
মার্কিন ভূতাত্ত্বিক জরিপ সংস্থা ইউএসজিএস জানিয়েছে, ভূমিকম্পটির কেন্দ্র ছিল পেট্রোপাভলোভস্ক-কামচাটস্কি শহর থেকে প্রায় ১৩০ কিলোমিটার দূরে এবং এর গভীরতা ছিল ১৯ কিলোমিটার। কম্পনের পর পরই রাশিয়া, জাপান, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, চিলি, পেরু, নিউজিল্যান্ড, ফিজি, সামোয়া, মেক্সিকোসহ অন্তত ১৮টি দেশ ও বিভিন্ন অঞ্চলে সুনামির সতর্কতা জারি করা হয়। হাওয়াই অঙ্গরাজ্যে জারি করা হয় জরুরি নির্দেশ। একইভাবে জাপানের উত্তরাঞ্চলের উপকূলবর্তী এলাকাগুলো থেকে স্থানীয়দের সরিয়ে নেয়া হয়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ ভূমিকম্প বিশেষ করে প্রশান্ত মহাসাগরের ‘রিং অব ফায়ার’ নামে পরিচিত অঞ্চলে থাকা দেশগুলোর জন্য বড় ধরনের সতর্কতা সংকেত। ‘রিং অব ফায়ার’ পৃথিবীর অন্যতম ভূকম্পন ও আগ্নেয়গিরি সক্রিয় অঞ্চল হিসেবে পরিচিত। এ বেষ্টনীতে প্রায়ই মাঝারি থেকে উচ্চমাত্রার ভূমিকম্প ও অগ্ন্যুৎপাত ঘটে। ভূতাত্ত্বিক বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এ অঞ্চল আগামী কয়েক দিন আরো ভূকম্পনের মুখোমুখি হতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞ জেসিকা লিউ বলেন, ‘৮ দশমিক ৮ মাত্রার ভূমিকম্প অত্যন্ত শক্তিশালী। এটি আশপাশের টেকটোনিক প্লেটগুলোকে প্রভাবিত করতে পারে। ফলে কিছু এলাকায় আফটার শক ও নতুন কম্পনের ঝুঁকি থেকেই যাচ্ছে।’
বিশ্বজুড়ে সুনামি পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রগুলো জানিয়েছে, ভূমিকম্পটি ছিল ‘মেগা থ্রাস্ট’ ধরনের, যা পৃথিবীর সবচেয়ে ভয়াবহ ভূমিকম্পের ধরন। এ ধরনের ভূকম্পন টেকটোনিক প্লেটগুলোর সীমানায় ঘটে। এতে প্রবল শক্তি নির্গত হয়, যার ফলে গভীর সাগরের পানি ধাক্কা খেয়ে বিশাল ঢেউয়ের সৃষ্টি করে। ২০০৪ সালে ভারত মহাসাগরের ভূমিকম্প ও সুনামির মতোই এ ধরনের মেগা থ্রাস্ট ভূমিকম্প থেকে বড় বিপর্যয় ঘটার শঙ্কা থাকে।
এদিকে রাশিয়ার কামচাটকা অঞ্চলের ক্লিউচেভস্কয় আগ্নেয়গিরি ভূমিকম্পের পর পরই অগ্ন্যুৎপাত শুরু করেছে। তবে এ অগ্ন্যুৎপাত কতটা ভয়াবহ হতে পারে বা সেটি সরাসরি ভূমিকম্পজনিত কিনা তা নিয়ে এখনো পরিষ্কার কোনো বক্তব্য দেয়নি রুশ কর্তৃপক্ষ। ভূমিকম্প ও অগ্ন্যুৎপাতের ঘটনায় রাশিয়ার দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয় ওই অঞ্চলের বেশকিছু শহর ও গ্রাম থেকে লোকজনকে সরিয়ে নেয়ার নির্দেশ দিয়েছে। সরকারি হিসাবে এখন পর্যন্ত রাশিয়ার মূল ভূখণ্ডে গুরুতর কোনো প্রাণহানি ঘটেনি।
জাপানের হোক্কাইডো ও হোনশু দ্বীপের উপকূলে সুনামির কারণে লক্ষাধিক মানুষকে সরিয়ে নেয়া হয়। জাপান সরকার জানায়, এটি ২০১১ সালের ৯ দশমিক ১ মাত্রার তোহোকু ভূমিকম্পের পর অন্যতম বৃহৎ সতর্কতা ব্যবস্থা। ভূমিকম্পের প্রভাবে ফুকুশিমা বা অন্য কোনো পারমাণবিক স্থাপনায় বড় কোনো ক্ষতির খবর পাওয়া যায়নি। তবে নিরাপত্তার খাতিরে বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর কাজ সাময়িকভাবে বন্ধ রাখা হয়েছে। ফুকুশিমা প্রশাসনের এক কর্মকর্তা জানান, ভূমিকম্পের সময় প্রচণ্ড দুলুনি অনুভূত হয় এবং তাৎক্ষণিকভাবে কেন্দ্রের জরুরি প্রটোকল চালু করা হয়।
যুক্তরাষ্ট্রের হাওয়াই অঙ্গরাজ্যে কমপক্ষে তিনটি দ্বীপে সতর্কতা জারি করে লোকজনকে নিরাপদ স্থানে সরে যেতে বলা হয়। প্রশান্ত মহাসাগরের প্যাসিফিক সুনামি ওয়ার্নিং সেন্টার জানায়, হাওয়াই দ্বীপে দুই-তিন ফুট উচ্চতার ঢেউ দেখা গেছে। এছাড়া ক্যালিফোর্নিয়া, ওরেগন ও আলাস্কার কিছু উপকূলীয় এলাকায় ছোট ঢেউ আছড়ে পড়েছে। তবে সেখানে বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতির খবর পাওয়া যায়নি। হাওয়াই বিমানবন্দর সাময়িকভাবে বন্ধ রেখে পরে আবার চালু করা হয়।
দক্ষিণ আমেরিকার চিলি ও পেরু সরকার উপকূলীয় এলাকাগুলোর জন্য রেড অ্যালার্ট জারি করেছে। চিলির জাতীয় দুর্যোগ সুরক্ষা সংস্থা জানিয়েছে, দেশটির উপকূলে ১ দশমিক ৮ মিটার উচ্চতার ঢেউ আছড়ে পড়েছে। নিরাপত্তার স্বার্থে কয়েক হাজার মানুষকে উপকূল থেকে সরিয়ে নেয়া হয়। পেরু সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়, দেশটির কিছু উপকূলে ঢেউয়ের উচ্চতা ২ দশমিক ৩১ মিটার পর্যন্ত পৌঁছতে পারে। উপকূলীয় এলাকায় জারি করা হয়েছে জরুরি অবস্থা।
কানাডার ব্রিটিশ কলাম্বিয়া উপকূলেও সতর্কতা জারি করা হয়। এখানকার কিছু ছোট দ্বীপে অস্থায়ীভাবে লোকজনকে সরিয়ে নেয়া হয়েছে। তবে বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতি হয়নি বলে প্রাদেশিক প্রশাসন জানিয়েছে। একইভাবে নিউজিল্যান্ডের উত্তর উপকূলে স্থানীয় সময় রাত ২টার দিকে সতর্কতা জারি করে লোকজনকে সমুদ্র থেকে দূরে থাকতে বলা হয়।
এ ভূমিকম্প ও সুনামি সতর্কতার পরিপ্রেক্ষিতে জাতিসংঘের পরমাণু তত্ত্বাবধান সংস্থা আইএইএ জানিয়েছে, প্রশান্ত মহাসাগরীয় উপকূলে অবস্থিত কোনো পারমাণবিক স্থাপনায় এখন পর্যন্ত নিরাপত্তা ঝুঁকি শনাক্ত হয়নি। তবে তারা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণে রেখেছেন, সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ রয়েছে।
ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, এ ভূমিকম্প শত বছরের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালীগুলোর একটি। রাশিয়ার কমচাটকা অঞ্চল ভূকম্পনপ্রবণ হলেও এত উচ্চমাত্রার ভূমিকম্প অতীতে খুব কমই দেখা গেছে। ইউএসজিএসের বিশেষজ্ঞ মাইকল নোলান বলেন, ‘এ মাত্রার ভূমিকম্প পৃথিবীর বুকে খুব কমই ঘটে। এ ভূকম্পনের পরিপ্রেক্ষিতে আফটার শকের সম্ভাবনাও রয়েছে, যা ক্ষয়ক্ষতি বাড়াতে পারে।’
ভূমিকম্পের পর রাশিয়ার বেশ কয়েকটি দ্বীপে অস্থায়ী আশ্রয় কেন্দ্র খোলা হয়েছে। কামচাটকার সেভেরো-কুরিলস্ক এলাকায় স্থানীয় প্রশাসন নিশ্চিত করেছে যে কয়েক হাজার মানুষকে নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে নেয়া হয়েছে। এর মধ্যে অধিকাংশই শিশু ও প্রবীণ। ওই এলাকায় সাময়িকভাবে বিদ্যুৎ ও পানি সরবরাহ বন্ধ ছিল। তবে দ্রুতই জরুরি সেবা পুনরায় চালু করা হয়।
আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা ও বিভিন্ন দেশের প্রশাসন পরিস্থিতির ওপর নিবিড় নজর রাখছে। নাগরিকদের বারবার বলা হচ্ছে যতক্ষণ না নিশ্চিতভাবে বিপদ কেটে যায়, ততক্ষণ তারা যেন উপকূলীয় এলাকায় ফিরে না যান। বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতি না হলেও ভূমিকম্পের মাত্রা ও বিস্তৃতি দেখে বিশ্লেষকরা বলছেন, এ ঘটনার প্রভাব দীর্ঘমেয়াদে প্রশান্ত অঞ্চলজুড়ে ঝুঁকির মাত্রা বাড়িয়ে দেবে।