মাইকে ঘোষণা দিয়ে সুনামগঞ্জের দিরাই ও শাল্লা উপজেলার আটটি জলমহালের মাছ লুট করে নিয়ে গেছে স্থানীয় হাজারো লোকজন। ইজারাদারদের দাবি, বিলগুলো থেকে অন্তত সাত কোটি টাকার মাছ লুট হয়েছে।
জানা যায়, এসব জলমহাল বিভিন্ন মৎস্যজীবী সমবায় সমিতি কাগজপত্রে ইজারা নিলেও বাস্তবে এগুলো ভোগদখল করতেন দিরাই ও শাল্লার প্রভাবশালী আওয়ামী লীগের নেতারা। ফলে এলাকার সাধারণ মানুষ জলমহালগুলোতে মাছ ধরার কোনো সুযোগ পেতেন না।
দীর্ঘ ১৫ বছর ধরে সরকারের কাছ থেকে মৎস্যজীবী সমবায় সমিতির নামে ইজারা নিয়ে জলমহালগুলোতে বাঁশ দিয়ে মাছের অভয়াশ্রম তৈরি করে তিন বছর মাছ প্রতিপালন করে চার বছরের মধ্যে তারা জলমহালগুলো থেকে মাছ ধরে কোটি কোটি টাকার মাছ বিক্রি করতেন। জলমহাল পাহারা দেয়া ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য আলাদা পাহারাদার ও মাছের উৎপাদনের জন্য কৈবর্ত সম্প্রদায়ের জেলেদের নিয়োগ দিতেন।
প্রভাবশালী আওয়ামী লীগের নেতাদের পাহারাদারদের ভয়ে সাধারণ মানুষ জলমহালের পানিতে নামতে ভয় পেতেন। ৫ আগস্ট পটপরিবর্তনের পর আওয়ামী লীগ নেতারা পালিয়ে গেলে সাধারণ মানুষ জলমহালে জাল দিয়ে মাছ ধরার সুযোগ পান। গত কয়েকদিন ধরে তাদের মধ্যে পলো দিয়ে মাছ ধরার উৎসবের কথা বলে গ্রামের সব মানুষ মিলে জলমহালগুলোতে মাছ ধরতে যান।
সংশ্লিষ্টরা জানান, মূলত ৫ আগস্টের পর জলমহালগুলো আওয়ামী লীগের নেতাদের হাত ছাড়া হয়ে সাধারণ মানুষ ও জেলেদের অধিকার প্রতিষ্ঠা পায়।
তবে কাগজে জলমহালের মালিক বিভিন্ন মৎস্যজীবী সমবায় সমিতির লোকজনের অভিযোগ, হাজার হাজার মানুষ মাছ ধরার জাল, পলো, লোহার ধারালো কুচ ইত্যাদি নিয়ে সংঘবদ্ধ হয়ে জলমহালে মাছ ধরে নিয়ে যাওয়ায় তাদের কয়েক কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। প্রতি বছর সরকারকে ৪৫ লাখ টাকা খাজনা দিয়ে ৬ বছরের জন্য সাতোয়া জলমহালটি ইজারা পেয়েছিলেন। তারা প্রতি দুই বছর জলমহালের মাছ সংরক্ষণ ও প্রতিপালন করে তিন বছর হলে জলমহাল থেকে মাছ ধরে বিক্রি করবেন।
স্থানীয়রা জানান, জলমহালগুলো মৎস্যজীবী সমবায় সমিতির নামে কাগজে পত্রে লিজ এনে দীর্ঘদিন ধরে আওয়ামী লীগের প্রভাবশালীরা নিয়ন্ত্রণ করেন। নেতারা পালিয়ে যাওয়ার পর জলমহালের আশপাশের অসংখ্য গ্রামের লোকজন জোর করে মাছ ধরে নিয়ে যান। মেঘনা বারোঘর জলমহালের অলিখিত মালিক ছিলেন দিরাই উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পলাতক প্রদীপ রায় ও জেলা আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী বেশ কয়েকজন নেতা। তিনটি জলমহাল ভূমি মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে ৬ বছরের জন্য উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় মৎস্যজীবী সমবায় সমিতির নামে ইজারা এনে তারা ভোগদখল ও রক্ষণাবেক্ষণ করেন।
দিরাই থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ আব্দুর রাজ্জাক জানান, বিভিন্ন গ্রামের হাজার হাজার মানুষ যখন বিলে পলো বাওয়ার কথা বলে মাছ ধরতে নেমে যান। তখন তাদের বুঝিয়ে কোনো লাভ হয়নি। হাজার হাজার মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করা সহজ বিষয় নয়। দিরাই উপজেলার ২০০ একরের চেয়ে বেশি আয়তনের বিশাল জলমহাল মেঘনা বারোঘর, কামান হাতনি জলমহালে হাজার হাজার লোক এসে পলো বাওয়ার নাম করে মাছ ধরে নিয়ে যায়। তখন বিলের পাহারাদারের পক্ষে তাদের বাধা দেয়া সম্ভব হয়নি।
ওসি মো. আব্দুর রাজ্জাক আরও জানান, মেঘনা ও কামান লাইরা দীঘা জলমহালের মাছ ইজারাদাররা অনেক আগেই ধরে বিক্রি করেছেন বলে জেনেছি। এখন ফাল্গুন মাস পেরিয়ে চৈত্রমাস আসছে, বিলে মাছ ধরার আর খুব বেশি সময় নেই। যারা জোর করে মাছ ধরে নিয়ে গেছেন তাদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় নিয়ে আসা হবে। এ বিষয়ে লিখিত অভিযোগ পেয়েছি।
এ বিষয়ে কামান বিলের ইজারাদার চরনারচর বিএম মৎস্যজীবী সমবায় সমিতি লিমিটেডের সাধারণ সম্পাদক সুধীর বিশ্বাস জানান, প্রতি বছর বিলের জন্য সরকারকে ৫০ লাখ টাকা খাজনা দেয়া হয়। গেল দুদিনে তাদের দুই কোটি টাকার মাছ লুট করে নিয়ে গেছে হাজার হাজার মানুষ। ১৯৭ একর আয়তনের জলমহালের মাছ ধরতে ৬ মাস সময় লাগে। ৫০ জন মৎস্যজীবী দীর্ঘদিন ধরে মাছের পরিচর্যা ও সংরক্ষণ করে আসছেন।
তিনি আরও জানান, যমুনা জালের বের দিয়ে বিলের মাছ তীরে টেনে নিয়ে আসছিলেন তারা। জলমহালে দুই বছর ধরে মাছ প্রতিপালন করা হয়। চলতি বছর ছিল ফিশিংয়ের সময়। হাজার হাজার মানুষ একদিনেই বিলের ছোট বড় সব মাছ ধরে নিয়ে যায়।
এতে মৎস্যজীবী সমবায় সমিতিগুলো ৭ কোটি টাকার মাছ ধরে নেয়ার দাবি করেন নবীনগর উত্তর মৎস্যজীবী সমবায় সমিতি লিমিটেডের সাধারণ সম্পাদক প্রীতুষ বর্মণ। তিনি বলেন, জামালগঞ্জ উপজেলার আয়লা ছাদাইয়া গ্রুপ জলমহাল তারা সমিতির মাধ্যমে উন্নয়ন ফিসারি হিসেবে ইজারা নিয়েছিলেন। জলমহালে মাছের পোনা ফেলে পালন ও সংরক্ষণ করছিলেন। জামালগঞ্জ উপজেলার নাজিমনগর হঠামারা দিরাই উপজেলার সিচনি রফিনগর মির্জাপুর, খাগাউড়া, বাংলাবাজারসহ ১০টি গ্রামের হাজার হাজার মানুষ পলো বাইছের নাম করে বিলের মাছ ধরে নিয়ে যায়।
তিনি ঘটনাটি লিখিত ভাবে সুনামগঞ্জ জেলা জলমহাল ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি ও জেলা প্রশাসক ড. মোহাম্মদ ইলিয়াস মিয়াকে জানিয়েছেন।
এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ ইলিয়াস মিয়া জানান, একটি জলমহাল থেকে জোর করে মাছ ধরে নিয়ে যাওয়ার লিখিত অভিযোগ পেয়েছেন তিনি। এছাড়া আর কোনো অভিযোগ পাননি। জলমহালের মাছ লুটপাটের জড়িতদের আইনের আওতায় নিয়ে আসতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে কথা বলে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।