ঢাকার সবচেয়ে ব্যস্ত প্রবেশপথ যাত্রাবাড়ী। ঢাকা-চট্টগ্রাম, ঢাকা-সিলেট ও ঢাকা-খুলনার মতো জাতীয় মহাসড়ক মিলেছে এ পয়েন্টে। যানবাহনের চাপ আর অনিয়ম-অব্যবস্থাপনায় যাত্রাবাড়ী এলাকা দীর্ঘদিন ধরেই রাজধানীর যানজটের একটি বড় কেন্দ্র। ২০২২ সালে পদ্মা সেতু চালুর পর যাত্রাবাড়ীর যানজট আরো প্রকট হয়েছে। বর্তমানে ব্যস্ত সময়গুলোয় শুধু যাত্রাবাড়ী পয়েন্ট পার হতেই লেগে যাচ্ছে ২-৩ ঘণ্টা।
সরকারের সংশোধিত কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনায় (আরএসটিপি) পদ্মা সেতু চালু হলে যাত্রাবাড়ী এলাকায় ভয়াবহ যানজটের পূর্বাভাস দেয়া হয়েছিল। এ যানজট এড়াতে পদ্মা সেতু চালুর আগেই ঢাকার ‘আউটার’ অথবা ‘মিডল’ রিংরোডের দক্ষিনাংশ অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নির্মাণের সুপারিশও করা হয়েছিল। যোগাযোগ অবকাঠামো বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, ওই সুপারিশ আমলে না নেয়ার কারণেই যাত্রাবাড়ীর যানজট এখন ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে।
পদ্মা সেতু নির্মাণে বাংলাদেশ সরকারের ব্যয় হয়েছে প্রায় ৩১ হাজার কোটি টাকা। আরো প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণে। বিপুল অংকের এ বিনিয়োগের আগে রিংরোড নির্মাণের মতো যেসব পূর্বশর্ত ছিল, তার কোনোটিই পূরণ হয়নি বলে মনে করেন যোগাযোগ অবকাঠামো বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ড. সামছুল হক।
এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘যেকোনো অবকাঠামো উন্নয়নের আগে কিছু পূর্বশর্ত পূরণ করতে হয়। পদ্মা সেতু ও মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণের জন্য মোটা অংকের অর্থ বিনিয়োগ করা হয়েছে। এ বিনিয়োগের পূর্বশর্ত ছিল ঢাকায় রিংরোড নির্মাণ করা, যেন পদ্মা সেতু ও এক্সপ্রেসওয়ে ব্যবহার করে আসা যানবাহন দ্রুত ঢাকার ভেতরে প্রবেশ করতে পারে। এটা হলে উত্তরার দিকে যার গন্তব্য, তিনি রিংরোড ব্যবহার করে উত্তরায় চলে যেতে পারতেন। একইভাবে যাদের মোহাম্মদপুরের দিকে গন্তব্য, তারা বছিলা হয়ে চলে যেতে পারতেন। কিন্তু রিংরোড না থাকায় সবাইকে এখন হয় গুলিস্তান, না হয় চানখাঁরপুল দিয়ে ঢাকায় ঢুকতে হচ্ছে। ফলে পুরো চাপ গিয়ে পড়ছে যাত্রাবাড়ী-গুলিস্তানের ওপর।’
তিনি বলেন, ‘পদ্মা সেতু চালুর পর ঢাকার অন্যতম প্রধান প্রবেশপথ যাত্রাবাড়ীতে যানজট বাড়বে, এটা বোঝার জন্য রকেট সায়েন্স জানার দরকার নেই। অবকাঠামো নির্মাণের ব্যাকরণ জানলেই হয়। এখানে ব্যাকরণগত ভুল রয়েছে। যারা এ ভুলের পেছনে দায়ী, তাদের জবাবদিহিতার আওতায় আনা এখন সময়ের দাবি।’
বৃহত্তর ঢাকার জন্য ২০০৫ সালে প্রণীত কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনা (এসটিপি) হালনাগাদ করে ২০১৫ সালে সংশোধিত কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনা প্রণয়ন করে সরকার। হালনাগাদ পরিকল্পনায় পদ্মা সেতু নির্মাণের আগেই ঢাকার জন্য প্রস্তাবিত আউটার সার্কুলার অথবা মিডল সার্কুলার রোডের দক্ষিণ অংশের কাজ সম্পন্নের সুপারিশ করা হয়েছিল।
এতে বলা হয়েছিল, পদ্মা সেতু চালু হলে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল থেকে ঢাকামুখী যানবাহনের চাপ বাড়বে। এ চাপ যাত্রাবাড়ী এলাকায় ভয়াবহ যানজট তৈরি করবে। আরএসটিপিতে ঢাকা আউটার রিংরোড অথবা মিডল রিংরোডের দক্ষিণ অংশ অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পদ্মা সেতু চালুর আগেই নির্মাণের সুপারিশ করা হয়েছিল।
সড়ক দুটি নির্মাণের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তরকে। সংস্থাটির কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, আরএসটিপিতে প্রস্তাবিত আউটার রিংরোডের দৈর্ঘ্য ১২৯ কিলোমিটার। হেমায়েতপুর-কালিকান্দি-মদনপুর-ডাঙ্গা-বাইপাইল-গাজীপুরের মধ্যে সড়কটি নির্মিত হওয়ার কথা। ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে আউটার রিংরোড নির্মাণের লক্ষ্যে একটি সম্ভাব্যতা সমীক্ষা সম্পন্ন করে সওজ অধিদপ্তর। তবে মাঠ পর্যায়ে কাজ এখনো শুরু হয়নি।
অন্যদিকে মিডল রিংরোডের একটি অংশ জয়দেবপুর-দেবগ্রাম-ভুলতা-মদনপুরের মধ্যে গড়ে তোলা হচ্ছে ঢাকা বাইপাস সড়ক। এ প্রকল্পের ৬০ শতাংশের বেশি কাজ সম্পন্ন হয়েছে। ২০২৫ সালের জুলাইয়ের মধ্যে রাস্তাটি চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হবে। তবে মিডল রিংরোডের ঢাকা বাইপাস অংশ চালু হলেও তা যাত্রাবাড়ী এলাকার যানজট নিরসনে ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে না বলে জানিয়েছেন সওজ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা।
তাদের ভাষ্যমতে, যাত্রাবাড়ী এলাকার যানজট নিরসনে মিডল রিংরোডের দক্ষিণ অংশ (হেমায়েতপুর-কালিকান্দি-তৃতীয় শীতলক্ষ্যা সেতু-মদনপুর-ভুলতা) সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখতে সক্ষম।
রিংরোড না থাকায় দেশের মানুষ পদ্মা সেতু ও ঢাকা-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়ের প্রকৃত সুফল থেকে বঞ্চিত হচ্ছে বলে মনে করেন বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. হাদিউজ্জামান। এ প্রসঙ্গে তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, ‘কথা ছিল পদ্মা সেতু ও মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ে দেশের উত্তরাঞ্চলের সঙ্গে দক্ষিণাঞ্চলের সহজ ও দ্রুত যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তুলবে। কিন্তু দেশের দুই অঞ্চলের সংযোগ ঘটাতে ঢাকায় যে রিংরোড নির্মাণের দরকার ছিল, সেটি হয়নি। উল্টো পদ্মা সেতু ও মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ে চালু হওয়ার পর যাতায়াতে যতটা সময় সাশ্রয় হচ্ছে, ঢাকায় প্রবেশ করতে গিয়ে এখন তার চেয়ে বেশি সময় নষ্ট হচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘আরএসটিপিতে পদ্মা সেতু চালুর আগেই রিংরোডের দক্ষিণ অংশ নির্মাণের সুপারিশ করা হয়েছিল। যদি পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রকল্প বাস্তবায়ন করার সংস্কৃতি আমাদের থাকত, তাহলে এতদিনে আমরা শুধু দক্ষিণ অংশ নয়, পুরো রিংরোডটিই করে ফেলতে পারতাম।’
বর্তমানে ঢাকা-সিলেট মহাসড়কটি এক্সপ্রেসওয়ে মানে উন্নীতকরণে একটি প্রকল্প চলমান রয়েছে। আবার ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কটি ১০ লেনে উন্নীত করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এ দুই মহাসড়কের উন্নয়নকাজ শেষ হলে তা যাত্রাবাড়ী এলাকায় যানজট আরো বাড়িয়ে দেবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করে অধ্যাপক হাদিউজ্জামান বলেন, ‘এখন সবচেয়ে জরুরি হলো ঢাকার এ প্রবেশপথের চাপ কমানো। ব্যবস্থাপনা ভালোভাবে করতে পারলে কিছুটা সুফল হয়তো পাওয়া যাবে। কিন্তু ভবিষ্যতের কথা যদি চিন্তা করি, তাহলে সবচেয়ে জরুরি হলো রিংরোডগুলো তৈরি করে ফেলা। আর আপাতত সমাধান হিসেবে হানিফ ফ্লাইওভারের নিচের সড়কটির অব্যবস্থাপনা দূর করা এবং প্রয়োজনীয় সংস্কার করা, যেন মহাসড়কটি অতিরিক্ত যানবাহনের চাপ কিছুটা হলেও সামাল দিতে পারে।’
যে আরএসটিপিতে ঢাকায় রিংরোড নির্মাণের সুপারিশ করা হয়েছে, সেটির বাস্তবায়নকাজ সমন্বয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থা ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ)। পদ্মা সেতু চালুর আগে ঢাকায় অন্তত একটি রিংরোডের দক্ষিণ অংশ অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নির্মাণের সুপারিশ থাকলেও তা বাস্তবায়ন না হওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক নীলিমা আখতার কোনো মন্তব্য করেননি।
বিষয়টি নিয়ে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব এহছানুল হক এবং সওজ অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী সৈয়দ মঈনুল হাসানের সঙ্গে যোগাযোগ করেও তাদের বক্তব্য পাওয়া যায়নি।