মঙ্গলবার বিকালে আখাউড়া স্থলবন্দর দিয়ে দেশে ফিরে কয়েকজন বাংলাদেশি অভিযোগ করেছেন, তারা ভারতে হয়রানির শিকার হয়েছেন
ভারতের সঙ্গে চলমান উত্তেজনাকর পরিস্থিতি তৈরির পর থেকে দেশটিতে ব্যবসা ও চিকিৎসার কাজে যাওয়া বাংলাদেশিরা হয়রানির শিকার হচ্ছেন বলে অভিযোগ করেছেন। এর মধ্যে আগরতলায় আবাসিক হোটেল থেকে বের করে বাংলাদেশিদের হেনস্তা করার ঘটনা ঘটেছে। তবে মঙ্গলবার (০৩ ডিসেম্বর) সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া স্থলবন্দর দিয়ে পণ্য আমদানি-রফতানি কার্যক্রম স্বাভাবিক আছে।
মঙ্গলবার বিকালে আখাউড়া স্থলবন্দর দিয়ে দেশে ফিরে কয়েকজন বাংলাদেশি অভিযোগ করেছেন, ভারতে ইমিগ্রেশনে হয়রানির মুখে পড়ছেন বাংলাদেশিরা। এর মধ্যে কেউ কেউ আগরতলায় আবাসিক হোটেলে হেনস্তার শিকার হয়েছেন। তাদের একজন কুমিল্লার লাকসাম উপজেলার বাসিন্দা ফরিদ মিয়া।
ফরিদ মিয়া জানিয়েছেন, ভিসার মেয়াদ ফুরিয়ে আসায় কলকাতা ভ্রমণের জন্য সোমবার আখাউড়া দিয়ে আগরতলায় যান। সেখানে গিয়ে বিপাকে পড়েন। বাংলাদেশি হওয়ায় ভাড়া নেওয়ার এক ঘণ্টা পরই তাকে হোটেল থেকে বের করে দেয় কর্তৃপক্ষ। তবে হোটেল থেকে বের করে দিলেও ফেরত দেওয়া হয়নি ভাড়ার টাকা। দিনভর অনেক চেষ্টার পর মঙ্গলবার বিকালে আখাউড়া স্থলবন্দর দিয়ে দেশে ফিরে আসেন তিনি।
দেশে ফিরে ফরিদ মিয়া আখাউড়া স্থলবন্দরে সাংবাদিকদের বলেছেন, হঠাৎ করে হোটেল কর্তৃপক্ষ এসে বলে বাংলাদেশিদের হোটেলে থাকতে দেওয়া হবে না। হোটেলের যে ভাড়া নিয়েছিল, সেটাও ফেরত দেয়নি। ভয় দেখিয়ে হোটেল থেকে বের করে দেওয়া হয়। পরে বাধ্য হয়ে শহর থেকে ৮০ কিলোমিটার দূরে এক আত্মীয়ের বাড়িতে গিয়ে রাত কাটিয়ে সকালে দেশে ফেরার জন্য চেকপোস্টের দিকে রওনা হই। এখানে এসে দেখি বিভিন্ন স্থানে বাংলাদেশবিরোধী বিক্ষোভ হচ্ছে। অনেক চেষ্টার পর বিকালে দেশে ফিরে আসি।
হেনস্তার শিকার হয়ে দেশে ফেরা নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের বাসিন্দা মুজিবুর রহমান জানান, তিনি শিলচরে ইন্টারন্যাশনাল ট্রেড ফেয়ারে জামদানি শাড়ির স্টল দিয়েছেন। সোমবার একদল যুবক জয় শ্রী রাম স্লোগান দিয়ে তার দোকান ভাঙচুর করে এবং বাংলাদেশি নাগরিকদের হুমকি দেয়। এ সময় তার দোকানের কয়েকটি জামদানি শাড়ি ছিঁড়ে ফেলে তারা। অনেকটা অরক্ষিত অবস্থায় খোলা আকাশের নিচে রাতযাপন করে মঙ্গলবার বিকালে নিজ দেশে ফিরে এসেছি। গত ৩০ বছর ধরে ভারতে আসা যাওয়া করি। কিন্তু এবারের পরিস্থিতি খুবই খারাপ। বাংলাদেশি দেখলেই মারধর করছে তারা।
মো. রাজীব হোসেন নামে এক পর্যটক অভিযোগ করেছেন, আগরতলায় আমাদেরকে হোটেল থেকে বের করে দিয়ে বলেছে কোনও বাংলাদেশিকে হোটেলে জায়গা দেবে না। আমাদের সঙ্গে তারা উগ্র আচরণ করেছে। প্রতিবেশী দেশ থেকে এমন আচরণ কখনও প্রত্যাশা করিনি। আবার ভারতে ইমিগ্রেশনে হয়রানির মুখে পড়ছে বাংলাদেশিরা। এমন পরিস্থিতি তৈরি করবে জানলে সেখানে যেতাম না।
আখাউড়া স্থলবন্দরের ব্যবসায়ী মো. নাসির উদ্দিন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আখাউড়া দিয়ে মঙ্গলবার সকাল থেকে আমদানি-রফতানি কার্যক্রম স্বাভাবিক আছে। আমরা আজ মাছ ও শুঁটকি পাঠিয়েছি।’
আখাউড়া আন্তর্জাতিক ইমিগ্রেশন চেকপোস্ট সূত্রে জানা যায়, বাংলাদেশিদের হয়রানির ঘটনায় আখাউড়া দিয়ে মঙ্গলবার স্বাভাবিকের চেয়ে কম যাত্রী পারাপার হয়েছে। বিকাল ৪টা পর্যন্ত ১৪১ জন যাত্রী ভারতে গেছেন। ভারত থেকে বাংলাদেশে এসেছেন ১৪০ জন।
আখাউড়া স্থলবন্দরের ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, মাছ আমদানিতে আগ্রহ থাকলেও বাংলাদেশিদের জন্য ত্রিপুরা রাজ্যের আগরতলায় হোটেল পরিষেবা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। সোমবার ত্রিপুরার হোটেল মালিকদের এক সভা থেকে এ সিদ্ধান্ত নিয়ে বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়। এর আগে আইএলএস নামে একটি হাসপাতাল বাংলাদেশিদের চিকিৎসাসেবা দেবে না বলে ঘোষণা দেয়।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোটের মুখপাত্র চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারীকে গ্রেফতারের ঘটনায় দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি চলছে। বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতনের অভিযোগ তুলে ভারতের ত্রিপুরাসহ বিভিন্ন স্থানে নিয়মিত বিক্ষোভ হচ্ছে। ভারতীয় পতাকা অবমাননার অভিযোগ তুলে সে দেশে বাংলাদেশি পতাকা পুড়িয়ে দেওয়া হয়। সর্বশেষ সোমবার আগরতলায় বাংলাদেশ সহকারী হাইকমিশনারের কার্যালয়ে হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় ভারতের পক্ষ থেকে অবশ্য দুঃখ প্রকাশ করা হয়েছে। এরপর ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) নেতাকর্মীরা আগরতলা থেকে আখাউড়া স্থলবন্দরমুখী লংমার্চ কর্মসূচি দেয় মঙ্গলবার। কর্মসূচি ঘিরে সীমান্তে উত্তেজনাকর পরিস্থিতি থাকায় আখাউড়া সীমান্তে অতিরিক্ত বিজিবি সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে। সীমান্ত এলাকায় নিরাপত্তা জোরদার করা হয়।
আখাউড়া স্থলবন্দরের সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি হাসিবুল হাসান বলেন, ‘আগরতলায় ব্যবসায়ীদের সভা থাকায় মঙ্গলবার সকাল থেকেই মাছ পাঠানো হয়েছে। আগরতলার সভা থেকে নেতিবাচক কোনও তথ্য বা সংবাদ আসবে না বলে আমরা আশা করছি।’
আখাউড়া ইমিগ্রেশন চেকপোস্টের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. খাইরুল আলম বলেন, ‘বাংলাদেশে আসা যাত্রীদের বেশিরভাগ বাংলাদেশি। ভারতে যাওয়া যাত্রীদের বেশিরভাগ ভারতীয়। ভারতফেরত বাংলাদেশি যাত্রীরা হোটেল থেকে বের করে দেওয়া, মার্কেটে বাংলাদেশি পরিচয় পেয়ে পণ্য বিক্রিতে বাধা এবং ইমিগ্রেশনে হয়রানি করা হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন। বিষয়গুলো ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি।’
৬০ বিজিবি ব্যাটালিয়নের কোম্পানি কমান্ডার লে. কর্নেল এ এম জাবের বিন জব্বার বলেন, ‘সীমান্তে যেকোনো ধরনের অপতৎপরতা রোধ করার লক্ষ্যে প্রস্তুত রয়েছে বিজিবি। আখাউড়া সীমান্তে স্বাভাবিকের চেয়ে অতিরিক্ত ফোর্স মোতায়েন করা হয়েছে। সব মিলিয়ে সীমান্ত নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে।’