ঢাকা , শনিবার, ০৩ মে ২০২৫, ২০ বৈশাখ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

সরকারকে চাপে রাখতে মাঠে হেফাজত, ঢাকায় মহাসমাবেশ শনিবার

নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশন বাতিলসহ ৪ দফা দাবিতে আগামীকাল (শনিবার) ঢাকায় মহাসমাবেশ করতে যাচ্ছে হেফাজতে ইসলাম। কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক সংগঠনটি এই সমাবেশের মাধ্যমে বড় শোডাউন দিতে চাইছে, দেখাতে চাইছে বড় জমায়েত।সূত্র: বিবিসি বাংলা।

সারা দেশ থেকে লোক জমায়েত করতে সংগঠনটির বেশ তোড়জোড় দেখা যাচ্ছে।এরমধ্যেই শীর্ষ নেতারা দেশের বিভিন্ন জেলায় সাংগঠনিক সফর করেছেন। উদ্দেশ্য শনিবারের মহাসমাবেশে ঢাকায় লোক সমাগম ঘটানো।

হেফাজত এমন এক সময়ে ‘বড় কর্মসূচি’ নিয়েছে, যখন বাংলাদেশের রাজনীতিতে নানা মেরুকরণ ঘটছে। হেফাজতের নেতৃত্বের বেশিরভাগই বিভিন্ন ইসলামী দলের নেতা।

ফলে হেফাজতের কর্মসূচির পেছনে রাজনীতি আছে কিনা- সেই প্রশ্ন যেমন উঠছে, তেমনি দাবি আদায়ে মহাসমাবেশের মতো কর্মসূচি দেওয়ার প্রয়োজন হলো কেন- সেই প্রশ্নও তুলছেন কেউ কেউ।

যদিও হেফাজত বলছে, ‘কর্মসূচির পেছনে কোনো রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নেই।’

হেফাজতে ইসলামের যুগ্ম মহাসচিব মামুনুল হক বলেন, ‘এখান থেকে ইসলামী দলগুলোর কোনো রাজনৈতিক অভিপ্রায় দেখছি না আমি।’

কর্মসূচির দিয়ে হেফাজত কী আদায় করতে চায়?

হেফাজতে ইসলামের নেতারা মহাসমাবেশের মতো কর্মসূচির কথা প্রথম ভাবতে থাকেন গত রমজানে। তখন রমজান মাসের শেষ দিকে ঢাকায় বৈঠকে বসেন সংগঠনের শীর্ষ নেতারা।

যেখানে মূল ইস্যু ছিল–– সংগঠনটির নেতাকর্মীদের নামে দায়ের হওয়া মামলা প্রত্যাহার এবং শাপলা চত্বরে গণহত্যার বিচার।এ ছাড়া সংবিধানে বহুত্ববাদের পরিবর্তে আল্লাহর ওপর আস্থা ও বিশ্বাস পুনর্বহালের কথাও বলা হয়। উঠে আসে ফিলিস্তিন ও ভারতে মুসলিম নির্যাতনের প্রসঙ্গ।

সেই বৈঠকেই মূলত মামলা প্রত্যাহার এবং শাপলা চত্বরে গণহত্যার বিচার দাবি করে সরকারের ওপর এক ধরনের চাপ প্রয়োগের সিদ্ধান্ত হয়।কারণ, হেফাজত নেতারা মনে করেন- তাদের মামলা প্রত্যাহার কার্যক্রমে ‘যথেষ্ট গতি নেই’।তখন থেকেই হেফাজতের এই সমাবেশ আলোচনা তৈরি করে। কারণ, শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সঙ্গে হেফাজতের সুসম্পর্ক ও যোগাযোগ আছে।

মামলাসহ বিভিন্ন দাবি-দাওয়ার বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টাসহ আইন উপদেষ্টার সঙ্গে হেফাজত নেতাদের বৈঠকের কথাও প্রকাশ হয়েছে গণমাধ্যমগুলোতে।কিন্তু এর মধ্যেই মামলা প্রত্যাহারের জন্য সমাবেশ করে সরকারকে চাপ দেওয়ার প্রয়োজন কেন পড়ল?

জানতে চাইলে হেফাজতে ইসলামের যুগ্ম মহাসচিব আজিজুল হক ইসলামাবাদী বলেন, মামলা প্রত্যাহার পিছিয়ে গেলে নির্বাচনের পর নতুন যে সরকার ক্ষমতায় আসবে, তারা এসব মামলাগুলোকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে পারে।

তিনি বলেন, ‘আমরা সমাবেশ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি, কারণ সরকার তো ইতোমধ্যেই নির্বাচন দেওয়ার একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তো নির্বাচনের আবহ তৈরি হলে আমাদের মামলাগুলো প্রত্যাহার হবে না। আমরা একটা রাজনৈতিক মারপ্যাঁচে পড়ে যাব। সরকার তো অনেকের হাজারো দাবি মানছে, তাহলে আমাদের দাবি মানতে সমস্যা কোথায়?’

ইসলামাবাদী বলেন, ‘নির্বাচিত সরকার চলে আসার পর তখন তো বিশ্বাস করা যাবে না, তারা কখন কোন দেশের অ্যাজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে শুরু করে দেয়। আমাদের আশঙ্কা, তেমনটা হলে তখন এই মামলাগুলো আর প্রত্যাহার করা হবে না। তখন এই মামলাগুলো রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করার আশঙ্কা আছে।’

হেফাজত কেন কমিশনই বাতিল করতে বলছে?

হেফাজত শুরুতে মামলা প্রত্যাহোরের মতো বিষয়গুলো সামনে আনলেও মহাসমাবেশের পরিকল্পনা গতি পায় চলতি এপ্রিলের শেষ দিকে। এই সময়ে নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশন তাদের প্রতিবেদন তুলে দেয় প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে।

নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশন তার প্রতিবেদন দেওয়ার পরপরই এর বিভিন্ন বিষয় নিয়ে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেয় ইসলামপন্থি দলগুলো। তৎপর হয় হেফাজতে ইসলামও।

সংগঠনটির মহাসমাবেশ কর্মসূচির প্রথম দফা দাবি হিসেবেই তুলে ধরা হয় নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশন ও এর প্রতিবদন বাতিলের বিষয়।

দ্বিতীয় দফায় দাবিতে বলা হয়, সংবিধানে বহুত্ববাদের পরিবর্তে আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস পুনর্বহাল করতে হবে।

তৃতীয় দফায় হেফাজতের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া সব মামলা প্রত্যাহার ও শাপলা চত্বরের হত্যাকাণ্ডসহ সব গণহত্যার বিচার চাওয়া হয়।

সবশেষ চতুর্থ দফা দাবিতে তুলে ধরা হয় ফিলিস্তিন ও ভারতে ‘মুসলিম গণহত্যা ও নিপীড়ন বন্ধের’ কথা।

এই চার দফা দাবি নিয়ে সংগঠনটির নেতারা ইতোমধ্যেই দেশের গুরুত্বপূর্ণ জেলার মাদ্রাসাগুলোতে সফর করেছেন।

সংগঠনটির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব মহাসমাবেশ সফল করার দিক নির্দেশনা দেওয়ার পাশাপাশি লোক জমায়েতেরও তাগিদ দিয়েছেন তৃণমূলে।

এই প্রক্রিয়ায় বড় বিষয় হয়ে উঠেছে নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন। যেখানে উত্তরাধিকার সম্পত্তিতে নারীদের সমান অধিকার, বহুবিবাহ বন্ধের প্রস্তাব, যৌনকর্মীদের শ্রমিক হিসেবে স্বীকৃতি, বিভিন্ন বিষয়ে নারী-পুরুষ সমান অধিকার দেওয়ার মতো প্রস্তাবগুলোকে ‘ইসলামবিরোধী’ হিসেবে দেখছেন হেফাজত নেতারা।

মামুনুল হক বলেন, ‘ইসলামবিরোধী হওয়ার কারণে তারা কমিশনকেই বাতিল চান।উত্তরাধিকার সম্পত্তিতে ছেলেকে মেয়ের তুলনায় দ্বিগুণ সম্পত্তি এবং মেয়েকে ছেলের তুলনায় অর্ধেক সম্পত্তির যে বিধান আছে, এই বিধানকে তারা পরিবর্তন করার দাবি জানাচ্ছে। এটা তো সরাসরি কুরআনবিরোধী অবস্থান। ইসলামে পতিতাবৃত্তি নিষিদ্ধ, কিন্তু তারা একে শ্রমিকের স্বীকৃতি দিতে বলছেন। তাদের পুনর্বাসন না করে স্বীকৃতি দিলে এটা তো আরও উৎসাহিত হবে।’

তিনি বলেন, ‘এরকম বিভিন্ন প্রস্তাব আছে সেখানে যেগুলো কুরআন এবং ইসলামবিরোধী। ফলে এ ধরনের প্রস্তাব থাকার কারণে এই প্রতিবেদন বাতিল, এটাকে প্রত্যাখ্যান করা এবং এ ধরনের প্রস্তাবনার দায়ে কমিশনকেও বাতিল করতে হবে। এটাই আমাদের দাবি।’

‘মনস্তাত্ত্বিক চাপ’ তৈরির অভিযোগ হেফাজতের বিরুদ্ধে

বাংলাদেশে গত ১৯ এপ্রিল নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন পেশের পর এটা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা আছে, সেটা ঠিক। এই সমালোচনায় ধর্মীয় বিষয়গুলোও সামনে আসছে।কিন্তু বিতর্ক কিংবা সংলাপের মতো পদক্ষেপের বাইরে এসে হেফাজতে ইসলাম যেভাবে পুরো প্রতিবেদনকেই বাতিল করার কথা বলছে এবং মহাসমাবেশের মতো কর্মসূচি দিচ্ছে সেটাকে এক ধরনের চাপ প্রয়োগের চেষ্টা হিসেবেই দেখছেন নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের সদস্য ফাওজিয়া করিম ফিরোজ।

তিনি বলেন, ‘আমরা জানতাম যে বিরোধিতা হবে। কিন্তু সেজন্য যে রিপোর্ট তুলে ফেলে দিতে বলবে, এরকম চিন্তা করিনি। মানুষকে তো একাডেমিক আলোচনা করতে দেবেন। একাডেমিক বিরোধিতায় আসেন, সেটা ঠিক আছে। কিন্তু আপনি একটা মিটিং ডাকলেন, শত শত লোক আসল, সবাই ইয়েস স্যার বলবে এবং আমাদেরকে বের করে দিতে চাইবেন, আমাদেরকে চিহ্নিত করবেন– এটা ঠিক নয়। এটা মনস্তাত্ত্বিক চাপ সৃষ্টি করছে।’

ফাওজিয়ার ভাষ্য, কমিশন ধর্মীয় আইনকে বাধা দেয়নি। বরং তারা সব নারীর জন্য ঐচ্ছিক হিসেবে একটা নতুন আইনি বিকল্প হাজির করতে চেয়েছেন।আমরা কিন্তু ধর্মীয় আইনে কোনো বাধা দেওয়ার কথা বলিনি। ধর্মীয় আইনকে টাচ করিনি। আমরা শুধু বলেছি, একটা সিভিল ল’ করা উচিত যে আইনের মাধ্যমে প্রতিটি নারী তাদের সমঅধিকার অর্জন করবে এবং এটা ঐচ্ছিক হবে। আমরা সরকারের কাছে একটা প্রতিবেদন দিয়েছি বলেই যে এটা গ্রহণ হয়ে গেল তেমনটা তো না। সবমিলিয়ে যে পরিস্থিতি তাতে এক ধরনের ভীতি বা উদ্বেগ স্পষ্ট।

‘আমরা নিজেরাই আতঙ্কিত’ বলছেন হেফাজত নেতা

নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন নিয়ে ইসলামপন্থি দলগুলোর নানা বক্তব্য এবং হেফাজতের মাঠের কর্মসূচিকে এক ধরনের ভীতি ছড়ানোর চেষ্টা হিসেবে নারী অধিকার আন্দোলনে সম্পৃক্তদের কেউ কেউ মনে করছেন।ওই কমিশনের সদস্য ফাওজিয়া করিম ফিরোজ একে ব্যাখ্যা করেছেন ‘মনস্তাত্ত্বিক চাপ’ হিসেবে।

তবে এ ব্যাপারে জানতে চাইলে হেফাজত ইসলামের নেতা মামুনুল হক তাদের কর্মসূচির মাধ্যমে ভীতি বা আতঙ্ক ছড়ানোর অভিযোগ নাকচ করেন। উল্টো দাবি করেন, নারী সংস্কার কমিশনের রিপোর্টে ‘ইসলামবিরোধী’ প্রস্তাবের কারণে মুসলমানদের মধ্যে ‘আতঙ্ক তৈরি হয়েছে’।

মামুনুল হক বলেন, ‘আমরা তো সেই আতঙ্কে আতঙ্কিত যে তারা যেসব পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে, তাতে আমাদের নারীরা এবং আমাদের সমাজ ইমান নিয়ে বসবাস করতে পারবে কিনা।’

মামুনুল হক পুরো কমিশনকেই ‘উদ্দেশ্যমূলক’ মনে করেন।তিনি বলেন, ‘ধর্মপালনকারী শ্রেণির মধ্য থেকে কোনো প্রতিনিধি রাখা হয়েছে এই কমিশনে? কমিশন গঠনটাই তো একটা উদ্দেশ্যমূলক মনে হচ্ছে। আমরা আশঙ্কা করছি, এই কমিশনের যে প্রস্তাবনা সেটা দ্রুত কার্যকর করার পদক্ষেপ নেওয়া হতে পারে। তখন পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হয়ে যাবে।ফলে আমরা বড় কর্মসূচি করছি যেন সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারি। ইতোমধ্যেই কিন্তু মাঠে ব্যাপক আওয়াজ হচ্ছে। কিন্তু সরকারি মহল থেকে নির্লিপ্ত অবস্থা দেখা যাচ্ছে। তার মানে তারা আমাদের এসব কথা-বার্তাকে কোনো পাত্তা দিচ্ছে না।’

হেফাজত নেতারা আশঙ্কা করছেন, তাদের ভাষায় কমিশনের প্রতিবেদন বাস্তবায়নের কাজ শুরু হয়ে যেতে পারে।যদিও এরকম কোনো উদ্যোগ বা আগ্রহ সরকারের তরফ থেকে এখনো দৃশ্যমান হয়নি।এমনকি অন্যান্য কমিশনের প্রতিবেদনের মতো নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের রিপোর্ট নিয়ে কোনো আলোচনার উদ্যোগও দেখা যায়নি।

কিন্তু এরপরও কমিশন বাতিলের মতো দাবি তুলে হেফাজতের আসন্ন মহাসমাবেশ এবং নতুন কর্মসূচির পরিকল্পনা যে উদ্বেগ আরও বাড়িয়ে দেবে সেটা স্পষ্ট।

জনপ্রিয়

সরকারকে চাপে রাখতে মাঠে হেফাজত, ঢাকায় মহাসমাবেশ শনিবার

প্রকাশিত: ১১ ঘন্টা আগে

নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশন বাতিলসহ ৪ দফা দাবিতে আগামীকাল (শনিবার) ঢাকায় মহাসমাবেশ করতে যাচ্ছে হেফাজতে ইসলাম। কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক সংগঠনটি এই সমাবেশের মাধ্যমে বড় শোডাউন দিতে চাইছে, দেখাতে চাইছে বড় জমায়েত।সূত্র: বিবিসি বাংলা।

সারা দেশ থেকে লোক জমায়েত করতে সংগঠনটির বেশ তোড়জোড় দেখা যাচ্ছে।এরমধ্যেই শীর্ষ নেতারা দেশের বিভিন্ন জেলায় সাংগঠনিক সফর করেছেন। উদ্দেশ্য শনিবারের মহাসমাবেশে ঢাকায় লোক সমাগম ঘটানো।

হেফাজত এমন এক সময়ে ‘বড় কর্মসূচি’ নিয়েছে, যখন বাংলাদেশের রাজনীতিতে নানা মেরুকরণ ঘটছে। হেফাজতের নেতৃত্বের বেশিরভাগই বিভিন্ন ইসলামী দলের নেতা।

ফলে হেফাজতের কর্মসূচির পেছনে রাজনীতি আছে কিনা- সেই প্রশ্ন যেমন উঠছে, তেমনি দাবি আদায়ে মহাসমাবেশের মতো কর্মসূচি দেওয়ার প্রয়োজন হলো কেন- সেই প্রশ্নও তুলছেন কেউ কেউ।

যদিও হেফাজত বলছে, ‘কর্মসূচির পেছনে কোনো রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নেই।’

হেফাজতে ইসলামের যুগ্ম মহাসচিব মামুনুল হক বলেন, ‘এখান থেকে ইসলামী দলগুলোর কোনো রাজনৈতিক অভিপ্রায় দেখছি না আমি।’

কর্মসূচির দিয়ে হেফাজত কী আদায় করতে চায়?

হেফাজতে ইসলামের নেতারা মহাসমাবেশের মতো কর্মসূচির কথা প্রথম ভাবতে থাকেন গত রমজানে। তখন রমজান মাসের শেষ দিকে ঢাকায় বৈঠকে বসেন সংগঠনের শীর্ষ নেতারা।

যেখানে মূল ইস্যু ছিল–– সংগঠনটির নেতাকর্মীদের নামে দায়ের হওয়া মামলা প্রত্যাহার এবং শাপলা চত্বরে গণহত্যার বিচার।এ ছাড়া সংবিধানে বহুত্ববাদের পরিবর্তে আল্লাহর ওপর আস্থা ও বিশ্বাস পুনর্বহালের কথাও বলা হয়। উঠে আসে ফিলিস্তিন ও ভারতে মুসলিম নির্যাতনের প্রসঙ্গ।

সেই বৈঠকেই মূলত মামলা প্রত্যাহার এবং শাপলা চত্বরে গণহত্যার বিচার দাবি করে সরকারের ওপর এক ধরনের চাপ প্রয়োগের সিদ্ধান্ত হয়।কারণ, হেফাজত নেতারা মনে করেন- তাদের মামলা প্রত্যাহার কার্যক্রমে ‘যথেষ্ট গতি নেই’।তখন থেকেই হেফাজতের এই সমাবেশ আলোচনা তৈরি করে। কারণ, শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সঙ্গে হেফাজতের সুসম্পর্ক ও যোগাযোগ আছে।

মামলাসহ বিভিন্ন দাবি-দাওয়ার বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টাসহ আইন উপদেষ্টার সঙ্গে হেফাজত নেতাদের বৈঠকের কথাও প্রকাশ হয়েছে গণমাধ্যমগুলোতে।কিন্তু এর মধ্যেই মামলা প্রত্যাহারের জন্য সমাবেশ করে সরকারকে চাপ দেওয়ার প্রয়োজন কেন পড়ল?

জানতে চাইলে হেফাজতে ইসলামের যুগ্ম মহাসচিব আজিজুল হক ইসলামাবাদী বলেন, মামলা প্রত্যাহার পিছিয়ে গেলে নির্বাচনের পর নতুন যে সরকার ক্ষমতায় আসবে, তারা এসব মামলাগুলোকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে পারে।

তিনি বলেন, ‘আমরা সমাবেশ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি, কারণ সরকার তো ইতোমধ্যেই নির্বাচন দেওয়ার একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তো নির্বাচনের আবহ তৈরি হলে আমাদের মামলাগুলো প্রত্যাহার হবে না। আমরা একটা রাজনৈতিক মারপ্যাঁচে পড়ে যাব। সরকার তো অনেকের হাজারো দাবি মানছে, তাহলে আমাদের দাবি মানতে সমস্যা কোথায়?’

ইসলামাবাদী বলেন, ‘নির্বাচিত সরকার চলে আসার পর তখন তো বিশ্বাস করা যাবে না, তারা কখন কোন দেশের অ্যাজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে শুরু করে দেয়। আমাদের আশঙ্কা, তেমনটা হলে তখন এই মামলাগুলো আর প্রত্যাহার করা হবে না। তখন এই মামলাগুলো রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করার আশঙ্কা আছে।’

হেফাজত কেন কমিশনই বাতিল করতে বলছে?

হেফাজত শুরুতে মামলা প্রত্যাহোরের মতো বিষয়গুলো সামনে আনলেও মহাসমাবেশের পরিকল্পনা গতি পায় চলতি এপ্রিলের শেষ দিকে। এই সময়ে নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশন তাদের প্রতিবেদন তুলে দেয় প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে।

নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশন তার প্রতিবেদন দেওয়ার পরপরই এর বিভিন্ন বিষয় নিয়ে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেয় ইসলামপন্থি দলগুলো। তৎপর হয় হেফাজতে ইসলামও।

সংগঠনটির মহাসমাবেশ কর্মসূচির প্রথম দফা দাবি হিসেবেই তুলে ধরা হয় নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশন ও এর প্রতিবদন বাতিলের বিষয়।

দ্বিতীয় দফায় দাবিতে বলা হয়, সংবিধানে বহুত্ববাদের পরিবর্তে আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস পুনর্বহাল করতে হবে।

তৃতীয় দফায় হেফাজতের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া সব মামলা প্রত্যাহার ও শাপলা চত্বরের হত্যাকাণ্ডসহ সব গণহত্যার বিচার চাওয়া হয়।

সবশেষ চতুর্থ দফা দাবিতে তুলে ধরা হয় ফিলিস্তিন ও ভারতে ‘মুসলিম গণহত্যা ও নিপীড়ন বন্ধের’ কথা।

এই চার দফা দাবি নিয়ে সংগঠনটির নেতারা ইতোমধ্যেই দেশের গুরুত্বপূর্ণ জেলার মাদ্রাসাগুলোতে সফর করেছেন।

সংগঠনটির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব মহাসমাবেশ সফল করার দিক নির্দেশনা দেওয়ার পাশাপাশি লোক জমায়েতেরও তাগিদ দিয়েছেন তৃণমূলে।

এই প্রক্রিয়ায় বড় বিষয় হয়ে উঠেছে নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন। যেখানে উত্তরাধিকার সম্পত্তিতে নারীদের সমান অধিকার, বহুবিবাহ বন্ধের প্রস্তাব, যৌনকর্মীদের শ্রমিক হিসেবে স্বীকৃতি, বিভিন্ন বিষয়ে নারী-পুরুষ সমান অধিকার দেওয়ার মতো প্রস্তাবগুলোকে ‘ইসলামবিরোধী’ হিসেবে দেখছেন হেফাজত নেতারা।

মামুনুল হক বলেন, ‘ইসলামবিরোধী হওয়ার কারণে তারা কমিশনকেই বাতিল চান।উত্তরাধিকার সম্পত্তিতে ছেলেকে মেয়ের তুলনায় দ্বিগুণ সম্পত্তি এবং মেয়েকে ছেলের তুলনায় অর্ধেক সম্পত্তির যে বিধান আছে, এই বিধানকে তারা পরিবর্তন করার দাবি জানাচ্ছে। এটা তো সরাসরি কুরআনবিরোধী অবস্থান। ইসলামে পতিতাবৃত্তি নিষিদ্ধ, কিন্তু তারা একে শ্রমিকের স্বীকৃতি দিতে বলছেন। তাদের পুনর্বাসন না করে স্বীকৃতি দিলে এটা তো আরও উৎসাহিত হবে।’

তিনি বলেন, ‘এরকম বিভিন্ন প্রস্তাব আছে সেখানে যেগুলো কুরআন এবং ইসলামবিরোধী। ফলে এ ধরনের প্রস্তাব থাকার কারণে এই প্রতিবেদন বাতিল, এটাকে প্রত্যাখ্যান করা এবং এ ধরনের প্রস্তাবনার দায়ে কমিশনকেও বাতিল করতে হবে। এটাই আমাদের দাবি।’

‘মনস্তাত্ত্বিক চাপ’ তৈরির অভিযোগ হেফাজতের বিরুদ্ধে

বাংলাদেশে গত ১৯ এপ্রিল নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন পেশের পর এটা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা আছে, সেটা ঠিক। এই সমালোচনায় ধর্মীয় বিষয়গুলোও সামনে আসছে।কিন্তু বিতর্ক কিংবা সংলাপের মতো পদক্ষেপের বাইরে এসে হেফাজতে ইসলাম যেভাবে পুরো প্রতিবেদনকেই বাতিল করার কথা বলছে এবং মহাসমাবেশের মতো কর্মসূচি দিচ্ছে সেটাকে এক ধরনের চাপ প্রয়োগের চেষ্টা হিসেবেই দেখছেন নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের সদস্য ফাওজিয়া করিম ফিরোজ।

তিনি বলেন, ‘আমরা জানতাম যে বিরোধিতা হবে। কিন্তু সেজন্য যে রিপোর্ট তুলে ফেলে দিতে বলবে, এরকম চিন্তা করিনি। মানুষকে তো একাডেমিক আলোচনা করতে দেবেন। একাডেমিক বিরোধিতায় আসেন, সেটা ঠিক আছে। কিন্তু আপনি একটা মিটিং ডাকলেন, শত শত লোক আসল, সবাই ইয়েস স্যার বলবে এবং আমাদেরকে বের করে দিতে চাইবেন, আমাদেরকে চিহ্নিত করবেন– এটা ঠিক নয়। এটা মনস্তাত্ত্বিক চাপ সৃষ্টি করছে।’

ফাওজিয়ার ভাষ্য, কমিশন ধর্মীয় আইনকে বাধা দেয়নি। বরং তারা সব নারীর জন্য ঐচ্ছিক হিসেবে একটা নতুন আইনি বিকল্প হাজির করতে চেয়েছেন।আমরা কিন্তু ধর্মীয় আইনে কোনো বাধা দেওয়ার কথা বলিনি। ধর্মীয় আইনকে টাচ করিনি। আমরা শুধু বলেছি, একটা সিভিল ল’ করা উচিত যে আইনের মাধ্যমে প্রতিটি নারী তাদের সমঅধিকার অর্জন করবে এবং এটা ঐচ্ছিক হবে। আমরা সরকারের কাছে একটা প্রতিবেদন দিয়েছি বলেই যে এটা গ্রহণ হয়ে গেল তেমনটা তো না। সবমিলিয়ে যে পরিস্থিতি তাতে এক ধরনের ভীতি বা উদ্বেগ স্পষ্ট।

‘আমরা নিজেরাই আতঙ্কিত’ বলছেন হেফাজত নেতা

নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন নিয়ে ইসলামপন্থি দলগুলোর নানা বক্তব্য এবং হেফাজতের মাঠের কর্মসূচিকে এক ধরনের ভীতি ছড়ানোর চেষ্টা হিসেবে নারী অধিকার আন্দোলনে সম্পৃক্তদের কেউ কেউ মনে করছেন।ওই কমিশনের সদস্য ফাওজিয়া করিম ফিরোজ একে ব্যাখ্যা করেছেন ‘মনস্তাত্ত্বিক চাপ’ হিসেবে।

তবে এ ব্যাপারে জানতে চাইলে হেফাজত ইসলামের নেতা মামুনুল হক তাদের কর্মসূচির মাধ্যমে ভীতি বা আতঙ্ক ছড়ানোর অভিযোগ নাকচ করেন। উল্টো দাবি করেন, নারী সংস্কার কমিশনের রিপোর্টে ‘ইসলামবিরোধী’ প্রস্তাবের কারণে মুসলমানদের মধ্যে ‘আতঙ্ক তৈরি হয়েছে’।

মামুনুল হক বলেন, ‘আমরা তো সেই আতঙ্কে আতঙ্কিত যে তারা যেসব পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে, তাতে আমাদের নারীরা এবং আমাদের সমাজ ইমান নিয়ে বসবাস করতে পারবে কিনা।’

মামুনুল হক পুরো কমিশনকেই ‘উদ্দেশ্যমূলক’ মনে করেন।তিনি বলেন, ‘ধর্মপালনকারী শ্রেণির মধ্য থেকে কোনো প্রতিনিধি রাখা হয়েছে এই কমিশনে? কমিশন গঠনটাই তো একটা উদ্দেশ্যমূলক মনে হচ্ছে। আমরা আশঙ্কা করছি, এই কমিশনের যে প্রস্তাবনা সেটা দ্রুত কার্যকর করার পদক্ষেপ নেওয়া হতে পারে। তখন পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হয়ে যাবে।ফলে আমরা বড় কর্মসূচি করছি যেন সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারি। ইতোমধ্যেই কিন্তু মাঠে ব্যাপক আওয়াজ হচ্ছে। কিন্তু সরকারি মহল থেকে নির্লিপ্ত অবস্থা দেখা যাচ্ছে। তার মানে তারা আমাদের এসব কথা-বার্তাকে কোনো পাত্তা দিচ্ছে না।’

হেফাজত নেতারা আশঙ্কা করছেন, তাদের ভাষায় কমিশনের প্রতিবেদন বাস্তবায়নের কাজ শুরু হয়ে যেতে পারে।যদিও এরকম কোনো উদ্যোগ বা আগ্রহ সরকারের তরফ থেকে এখনো দৃশ্যমান হয়নি।এমনকি অন্যান্য কমিশনের প্রতিবেদনের মতো নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের রিপোর্ট নিয়ে কোনো আলোচনার উদ্যোগও দেখা যায়নি।

কিন্তু এরপরও কমিশন বাতিলের মতো দাবি তুলে হেফাজতের আসন্ন মহাসমাবেশ এবং নতুন কর্মসূচির পরিকল্পনা যে উদ্বেগ আরও বাড়িয়ে দেবে সেটা স্পষ্ট।