ঢাকা , রবিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৫, ৭ বৈশাখ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
সর্বশেষ :
রবার্ট এফ কেনেডি হত্যাকাণ্ড নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে ১০ হাজার নথি প্রকাশ এপ্রিলের রাতের আকাশে দুর্লভ জ্যোতির্বৈজ্ঞানিক চমক কিশোরগঞ্জে ভেজাল খাদ্য তৈরির দায়ে ৪ প্রতিষ্ঠানকে ৪ লাখ টাকা জরিমানা মুন্সীগঞ্জে পুকুর থেকে ৩২৬ রাউন্ড চায়না রাইফেলের গুলি উদ্ধার গণ-অভ্যুত্থানের পর সমঝোতার সংস্কার দরকার: এনসিপি আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম ভিসির প্রতীকী চেয়ারে আগুন দিয়ে বিক্ষোভ কুয়েট শিক্ষার্থীদের আবাসিকে গ্যাস সংযোগ নিয়ে প্রতারণা: সতর্ক করলো তিতাস গ্যাস ঘুষ ও হয়রানির অভিযোগে ঠাকুরগাঁও সদর থানার ওসি স্ট্যান্ড রিলিজ সিলেট আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়ামে ‘শহীদ তুরাব স্ট্যান্ড’ নামকরণ চার বছরে এসএসসি পরীক্ষার্থী কমেছে তিন লাখের বেশি

পাঁচ টাকার নোটে ঠাঁই পেলো কুসুম্বা জামে মসজিদ

নওগাঁর কুসুম্বা মসজিদ, ইসলামী স্থাপত্যের এক অনন্য নিদর্শন, ৫৩৬ বছরের ঐতিহ্য ধারণ করে দাঁড়িয়ে আছে। এটি বর্তমানে বাংলাদেশের পাঁচ টাকার নোটে মুদ্রিত। মসজিদটি নওগাঁ জেলার মান্দা উপজেলায় অবস্থিত এবং জেলা সদর থেকে প্রায় ৩৫ কিলোমিটার দূরে। স্থানীয় ও বিদেশি দর্শনার্থীদের জন্য এটি একটি ঐতিহাসিক স্থান হিসেবে পরিচিত।

কুসুম্বা মসজিদটি সুলতানি আমলের একটি পুরাকীর্তি। ১২০৪ খ্রিষ্টাব্দে ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজী বাংলার সেন বংশীয় রাজা লক্ষণ সেনকে পরাজিত করে বাংলায় ইসলামের বিজয় কেতন উড়িয়েছিলেন। তার বিজয়ের ফলে বাংলায় ইসলাম দ্রুত প্রসারিত হয়। আফগান শাসনামলে, শূর বংশের শেষ শাসক গিয়াস উদ্দিন বাহাদুর শাহর রাজত্বকালে সুলাইমান নামক এক ব্যক্তির উদ্যোগে মসজিদটি নির্মিত হয়, যা ইসলাম প্রচারে গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হিসেবে গড়ে ওঠে।

ইতিহাসবিদদের মতে, মসজিদটির নির্মাণ ৯৬৬ হিজরির (১৫৫৮ খ্রিষ্টাব্দ) দিকে শুরু হয় এবং এর নির্মাণকাজে সময় লেগেছিল ৫৬ বছর। আফগান সুলতানদের শাসন পরিবর্তনের কারণে নির্মাণ কাজ কিছুটা থেমে গিয়েছিল, তবে তা পরে পুনরায় শুরু হয়। এই মসজিদটি বর্তমানে ইসলামের এক অনন্য নিদর্শন হয়ে দাঁড়িয়ে আছে এবং প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর কর্তৃক রক্ষণাবেক্ষণ করা হচ্ছে।

কুসুম্বা মসজিদটির বিশেষ বৈশিষ্ট্য হল এর স্থাপত্যশৈলী। মসজিদের চার কোণে চারটি মিনার রয়েছে, যা মসজিদের দেয়াল পর্যন্ত উঁচু এবং আট-কোনাকার। ছাদের উপর ছয়টি গম্বুজ রয়েছে, যা দুটি সারিতে বিন্যস্ত। মসজিদটি উত্তর-দক্ষিণে ৫৮ ফুট লম্বা এবং ৪২ ফুট চওড়া। চারপাশের দেয়াল প্রায় ছয় ফুট পুরু এবং বাইরের অংশ পাথর দিয়ে আবৃত। মসজিদের সম্মুখভাগে তিনটি খিলানযুক্ত দরজা রয়েছে—দুটি বড় এবং একটি অপেক্ষাকৃত ছোট।

মসজিদটির নির্মাণে ব্যবহৃত পাথরের অলংকরণ বেশ মনোমুগ্ধকর। মিহরাবগুলো খোদাইকৃত পাথরের নকশা দিয়ে ব্যাপকভাবে অলংকৃত, এবং স্তম্ভগুলোর ওপর খিলান স্থাপন করা হয়েছে, যার শীর্ষে রয়েছে কলস মোটিফের অলংকরণ। স্তম্ভগুলোর গায়ে ঝুলন্ত শিকল ঘণ্টার নকশা এবং মিহরাবের ফ্রেমে আঙুরগুচ্ছ ও লতার নকশা খোদিত। এছাড়া মসজিদের দেয়ালের বেশ কিছু অংশে কলস, বৃক্ষলতা ও গোলাপের নকশা রয়েছে, যা স্থাপত্যের সৌন্দর্য বাড়িয়ে দিয়েছে।

মসজিদটির স্থাপত্যশৈলী আজও রহস্যময় মনে হয়, কারণ ৫৩৬ বছর পার হলেও এর জৌলুস কমেনি। মসজিদের মোয়াজ্জেম মো. ইসরাফিল আলম বলেন, ‘এটি এক রহস্যময় মসজিদ। এত বছর পরেও এর আভা তেমনি উজ্জ্বল রয়েছে।’

মসজিদ সংলগ্ন এলাকায় ৭৭ বিঘা বিশাল একটি দিঘি রয়েছে, যা স্থানীয় জনগণ ও মুসল্লিদের পানির প্রয়োজনীয়তা মেটানোর জন্য খনন করা হয়েছিল। দিঘির পাড়েই রয়েছে ঐতিহাসিক কুসুম্বা মসজিদ।

সাব্বির নামে এক দর্শনার্থী বলেন, ‘আমি নবাবগঞ্জ থেকে এসেছি এবং এখানে মনের শান্তি পেতে এসেছি। মসজিদটির পাথুরে সৌন্দর্য দেখে খুবই ভালো লাগলো।’ অপর এক দর্শনার্থী বলেন, ‘এখানে অনেকে এসে মানত করে আল্লাহর কাছে দোয়া করেন, কারণ শোনা যায়, এখানে দোয়া কবুল হয়।’

এছাড়া কুসুম্বা মসজিদের অদূরে জমির মাঝে একটি সুলতানি আমলের পিলার রয়েছে, যা স্থানীয়দের মতে মসজিদের সীমানা চিহ্নিত করতে নির্মিত হয়েছিল।

কুসুম্বা মসজিদ কেবল একটি ধর্মীয় উপাসনালয় নয়, এটি বাংলাদেশের মুসলিম স্থাপত্যের একটি অমূল্য ঐতিহ্য। এর অনন্য স্থাপত্যশৈলী এবং ইতিহাস আজও সকলকে মুগ্ধ করে, এবং এটি আমাদের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের একটি গর্বিত অংশ হয়ে রয়েছে।

জনপ্রিয়

রবার্ট এফ কেনেডি হত্যাকাণ্ড নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে ১০ হাজার নথি প্রকাশ

পাঁচ টাকার নোটে ঠাঁই পেলো কুসুম্বা জামে মসজিদ

প্রকাশিত: ১১:১৮ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ১২ মার্চ ২০২৫

নওগাঁর কুসুম্বা মসজিদ, ইসলামী স্থাপত্যের এক অনন্য নিদর্শন, ৫৩৬ বছরের ঐতিহ্য ধারণ করে দাঁড়িয়ে আছে। এটি বর্তমানে বাংলাদেশের পাঁচ টাকার নোটে মুদ্রিত। মসজিদটি নওগাঁ জেলার মান্দা উপজেলায় অবস্থিত এবং জেলা সদর থেকে প্রায় ৩৫ কিলোমিটার দূরে। স্থানীয় ও বিদেশি দর্শনার্থীদের জন্য এটি একটি ঐতিহাসিক স্থান হিসেবে পরিচিত।

কুসুম্বা মসজিদটি সুলতানি আমলের একটি পুরাকীর্তি। ১২০৪ খ্রিষ্টাব্দে ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজী বাংলার সেন বংশীয় রাজা লক্ষণ সেনকে পরাজিত করে বাংলায় ইসলামের বিজয় কেতন উড়িয়েছিলেন। তার বিজয়ের ফলে বাংলায় ইসলাম দ্রুত প্রসারিত হয়। আফগান শাসনামলে, শূর বংশের শেষ শাসক গিয়াস উদ্দিন বাহাদুর শাহর রাজত্বকালে সুলাইমান নামক এক ব্যক্তির উদ্যোগে মসজিদটি নির্মিত হয়, যা ইসলাম প্রচারে গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হিসেবে গড়ে ওঠে।

ইতিহাসবিদদের মতে, মসজিদটির নির্মাণ ৯৬৬ হিজরির (১৫৫৮ খ্রিষ্টাব্দ) দিকে শুরু হয় এবং এর নির্মাণকাজে সময় লেগেছিল ৫৬ বছর। আফগান সুলতানদের শাসন পরিবর্তনের কারণে নির্মাণ কাজ কিছুটা থেমে গিয়েছিল, তবে তা পরে পুনরায় শুরু হয়। এই মসজিদটি বর্তমানে ইসলামের এক অনন্য নিদর্শন হয়ে দাঁড়িয়ে আছে এবং প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর কর্তৃক রক্ষণাবেক্ষণ করা হচ্ছে।

কুসুম্বা মসজিদটির বিশেষ বৈশিষ্ট্য হল এর স্থাপত্যশৈলী। মসজিদের চার কোণে চারটি মিনার রয়েছে, যা মসজিদের দেয়াল পর্যন্ত উঁচু এবং আট-কোনাকার। ছাদের উপর ছয়টি গম্বুজ রয়েছে, যা দুটি সারিতে বিন্যস্ত। মসজিদটি উত্তর-দক্ষিণে ৫৮ ফুট লম্বা এবং ৪২ ফুট চওড়া। চারপাশের দেয়াল প্রায় ছয় ফুট পুরু এবং বাইরের অংশ পাথর দিয়ে আবৃত। মসজিদের সম্মুখভাগে তিনটি খিলানযুক্ত দরজা রয়েছে—দুটি বড় এবং একটি অপেক্ষাকৃত ছোট।

মসজিদটির নির্মাণে ব্যবহৃত পাথরের অলংকরণ বেশ মনোমুগ্ধকর। মিহরাবগুলো খোদাইকৃত পাথরের নকশা দিয়ে ব্যাপকভাবে অলংকৃত, এবং স্তম্ভগুলোর ওপর খিলান স্থাপন করা হয়েছে, যার শীর্ষে রয়েছে কলস মোটিফের অলংকরণ। স্তম্ভগুলোর গায়ে ঝুলন্ত শিকল ঘণ্টার নকশা এবং মিহরাবের ফ্রেমে আঙুরগুচ্ছ ও লতার নকশা খোদিত। এছাড়া মসজিদের দেয়ালের বেশ কিছু অংশে কলস, বৃক্ষলতা ও গোলাপের নকশা রয়েছে, যা স্থাপত্যের সৌন্দর্য বাড়িয়ে দিয়েছে।

মসজিদটির স্থাপত্যশৈলী আজও রহস্যময় মনে হয়, কারণ ৫৩৬ বছর পার হলেও এর জৌলুস কমেনি। মসজিদের মোয়াজ্জেম মো. ইসরাফিল আলম বলেন, ‘এটি এক রহস্যময় মসজিদ। এত বছর পরেও এর আভা তেমনি উজ্জ্বল রয়েছে।’

মসজিদ সংলগ্ন এলাকায় ৭৭ বিঘা বিশাল একটি দিঘি রয়েছে, যা স্থানীয় জনগণ ও মুসল্লিদের পানির প্রয়োজনীয়তা মেটানোর জন্য খনন করা হয়েছিল। দিঘির পাড়েই রয়েছে ঐতিহাসিক কুসুম্বা মসজিদ।

সাব্বির নামে এক দর্শনার্থী বলেন, ‘আমি নবাবগঞ্জ থেকে এসেছি এবং এখানে মনের শান্তি পেতে এসেছি। মসজিদটির পাথুরে সৌন্দর্য দেখে খুবই ভালো লাগলো।’ অপর এক দর্শনার্থী বলেন, ‘এখানে অনেকে এসে মানত করে আল্লাহর কাছে দোয়া করেন, কারণ শোনা যায়, এখানে দোয়া কবুল হয়।’

এছাড়া কুসুম্বা মসজিদের অদূরে জমির মাঝে একটি সুলতানি আমলের পিলার রয়েছে, যা স্থানীয়দের মতে মসজিদের সীমানা চিহ্নিত করতে নির্মিত হয়েছিল।

কুসুম্বা মসজিদ কেবল একটি ধর্মীয় উপাসনালয় নয়, এটি বাংলাদেশের মুসলিম স্থাপত্যের একটি অমূল্য ঐতিহ্য। এর অনন্য স্থাপত্যশৈলী এবং ইতিহাস আজও সকলকে মুগ্ধ করে, এবং এটি আমাদের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের একটি গর্বিত অংশ হয়ে রয়েছে।