রফতানি কার্যক্রম পরিচালনার জন্য বিজিএমইএর সক্রিয় সদস্য কারখানাগুলোর রফতানি ঋণপত্রের বিপরীতে কাঁচামাল ব্যবহারের সনদ (ইউডি) নিতে হয়। স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে সংরক্ষিত তথ্যের এ ব্যবস্থা থেকে ২০২৩ সালে একক ইউনিট হিসেবে শীর্ষ প্রতিষ্ঠানগুলোর তালিকা সংগ্রহ করেছে বণিক বার্তা। পাশাপাশি সংগ্রহ করা হয়েছে চলতি বছরের ৭ অক্টোবর পর্যন্ত শীর্ষ রফতানিকারকদের তালিকা। এ তালিকা বিশ্লেষণে দেখা গেছে, শীর্ষ ১০ রফতানিকারক প্রতিষ্ঠানের অধিকাংশেরই রফতানি গত বছরের তুলনায় বেড়েছে।
এ বিষয়ে উদ্যোক্তাদের বক্তব্য হলো, আয়তন ও সক্ষমতার কারণে অনিশ্চয়তার মধ্যে ক্রেতারা বড় কারখানার ওপরেই আস্থা বেশি রাখেন। বিজিএমইএ সভাপতি খন্দকার রফিকুল ইসলাম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বৃহদায়তনের কারখানাগুলোর ক্রেতাদের আকার অনেক বড়। তাদের ক্রয়ের পরিমাণ ও সংখ্যাও বেশি। সমস্যার সময় ক্রয়াদেশ দেয়ার ক্ষেত্রে বড় ক্রেতারা চিন্তা করেন নিরাপদ কারা। তারা ভাবেন নিরাপদ হাতে দিলে ক্রয়াদেশ সুরক্ষিত থাকবে। তাদের বিশ্বাস, যেকোনো ধরনের সমস্যায়ও স্কয়ার, ডিবিএল, হা-মীম—এ ধরনের বড় কোম্পানিগুলো পণ্য রফতানি করবেই। বড় কম্পোজিট কোম্পানিগুলোর সুতা থেকে শুরু করে পোশাক তৈরি হওয়া পর্যন্ত সব ধরনের সক্ষমতা রয়েছে। তাই এটা একটা বড় কারণ হতে পারে যে ক্রেতারা সংকটের সময় ছোট বা মাঝারি কারখানাগুলোর চেয়ে বড় কারখানাগুলোর ওপরেই আস্থা বেশি রাখেন।’
প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সালের সারা বছরে একক ইউনিট হিসেবে সর্বোচ্চ রফতানিকারক প্রতিষ্ঠান জিএবি লিমিটেড। দ্বিতীয় অবস্থানে ছিল ডিবিএল গ্রুপের ফ্লেমিংগো ফ্যাশনস লিমিটেড। স্কয়ার গ্রুপের স্কয়ার ফ্যাশনস লিমিটেড ছিল তৃতীয় অবস্থানে। চতুর্থ থেকে দশম অবস্থানে ছিল যথাক্রমে হা-মীম গ্রুপের রিফাত গার্মেন্টস লিমিটেড, আল-মুসলিম গ্রুপের একেএম নিটওয়্যার লিমিটেড, ইকোটেক্স লিমিটেড, চিটাগং এশিয়ান অ্যাপারেলস লিমিটেড, কটন ক্লাব (বিডি) লিমিটেড, কমফিট কম্পোজিট নিট লিমিটেড এবং জিএমএস কম্পোজিট নিটিং ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড।
পরিসংখ্যান বিশ্লেষণে দেখা যায়, চলতি বছরে শীর্ষ ১০ প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সাতটিরই রফতানি বেড়েছে। প্রতিষ্ঠানগুলো হলো স্কয়ার ফ্যাশনস, রিফাত গার্মেন্টস, একেএম নিটওয়্যার, ইকোটেক্স, কটন ক্লাব (বিডি), কমফিট কম্পোজিট নিট ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড এবং জিএমএস কম্পোজিট নিটিং ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড।
স্কয়ার গ্রুপের অন্যতম রফতানিকারক ইউনিট স্কয়ার ফ্যাশনস লিমিটেড গত বছর ১২ মাসে মোট ২৭ কোটি ডলারেরও বেশি পোশাক রফতানির ঋণপত্র বাস্তবায়ন করেছে। চলতি বছরের ৭ অক্টোবরের মধ্যেই তা ৩০ কোটি ডলার ছাড়িয়েছে।
জানতে চাইলে স্কয়ার গ্রুপের অন্যতম কর্ণধার তপন চৌধুরী বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আমাদের কাছ থেকে পোশাক সরবরাহ নেয় বা ক্রয় করে এমন ব্র্যান্ডগুলো বাংলাদেশের অস্বাভাবিক পরিস্থিতি অনুধাবন করেও আমাদের সাপোর্ট দেয়া অব্যাহত রেখেছে। দ্বিতীয়ত, অন্যান্য কারখানায় শ্রম অসন্তোষ যেমনটা হয়েছে, সৌভাগ্যবশত আমাদের তেমন পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে হয়নি। আমাদের নিজেদের শ্রমিকদের জন্য কারখানার উৎপাদন ব্যাহত হয়নি। তারা আমাদের দেয়া সুযোগ-সুবিধা নিয়ে সন্তুষ্ট ছিলেন বলেই এটি সম্ভব হয়েছে। উৎপাদন যতটুকু ব্যাহত হয়েছে সেটা বাইরের কারণে। এটা না ঘটলে রফতানিতে আমাদের আরো ভালো ফলাফল করা সম্ভব ছিল।’
একক ইউনিট হিসেবে ডিবিএল গ্রুপের অন্যতম রফতানিকারক প্রতিষ্ঠান জিন্নাত নিটওয়্যারস লিমিটেড গত বছর ১৩তম অবস্থানে ছিল। প্রতিষ্ঠানটি গত বছর ১৩ কোটি ডলারেরও বেশি ঋণপত্র বাস্তবায়ন করেছে। চলতি বছর প্রথম ১০ মাস পার হওয়ার আগেই তা ১৪ কোটি ডলার ছাড়িয়েছে।
জানতে চাইলে ডিবিএল গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এমএ জব্বার বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আমাদের প্রতিষ্ঠানের রফতানি প্রবৃদ্ধি ধরে রাখা সম্ভব হয়েছে ক্রেতাদের সমর্থনের কারণে। অস্থির পরিস্থিতিতেও তারা আমাদের ওপর আস্থা ধরে রেখেছেন। তাদের ক্ষেত্রে হঠাৎ করে অন্য কোথাও সরে যাওয়ার সুযোগ ছিল না। যদিও অভ্যন্তরীণ প্রেক্ষাপটে বিদ্যুৎ-গ্যাস নিয়ে আমাদের অনেক সমস্যার মধ্যে পড়তে হলেও নিরবচ্ছিন্ন রাখতে ডিজেল ব্যবহার করে নিজস্ব ব্যবস্থাপনা ঠিক রাখতে হয়েছে। আবার বড় ক্ষতি মেনে নিয়ে আকাশপথে রফতানি করতে হলেও আমরা ব্র্যান্ড ক্রেতাদের “না” বলিনি। এভাবে দুই পক্ষই নিজ নিজ সম্মান বজায় রেখে একে অপরকে সহযোগিতা করতে পেরেছি। এসবের প্রভাবেই আমাদের রফতানি বেড়েছে।’
বড় রফতানিকারকরা বলছেন, শ্রম অসন্তোষ এখন কিছুটা কমে এসেছে। কিন্তু বিদ্যুৎ-জ্বালানির প্রাপ্যতা খু্বই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। নীতিনির্ধারকদের এখন শিল্প-কারখানায় গ্যাস ও বিদ্যুতের সরবরাহ স্বাভাবিক করার বিষয়ে মনোযোগ দেয়া দরকার। বিদ্যুৎ ও শ্রম ব্যয় বাড়ছে। প্রণোদনা দিয়ে হলেও রফতানিকারকদের প্রতিযোগিতামূলক সুবিধা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। অন্যথায় রফতানি নেতিবাচক হতে শুরু করবে। আর বিদ্যমান অসন্তোষ অব্যাহত থাকলে ক্রয়াদেশ অন্যত্র সরে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
এ বিষয়ে স্কয়ার গ্রুপের অন্যতম কর্ণধার তপন চৌধুরী বলেন, ‘দেশের পোশাক খাত খুব বেশি হাই-টেক শিল্প না। ফলে এ খাতের কাজগুলো খুব দ্রুত শিফট হওয়া সম্ভব। প্রত্যেক বড় ক্রেতা প্রতিষ্ঠানেরই নিজস্ব পরিকল্পনা থাকে। তাদের অনেক ধরনের মৌসুম থাকে যেমন ব্ল্যাক ফ্রাইডে, ক্রিসমাস। সময়মতো তাদের কনসাইনমেন্টগুলো যদি না পৌঁছায় তারা অনেক বড় ক্ষতির সম্মুখীন হবে। এজন্যই তারা একটা বিকল্প বা দ্বিতীয় সরবরাহ ক্ষেত্র বিবেচনায় রাখছে। এখনো তারা আমাদের দেশের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে। আশা করছি শ্রম অসন্তোষ নিরসনে ১৮ দফা নিয়ে যে চুক্তি হয়েছে, সেটি যথাযথভাবে অনুসরণ করলে পরিস্থিতি পুরোপুরি স্থিতিশীল হবে।’
ডিবিএল গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এমএ জব্বার বলেন, ‘জ্বালানি, অসন্তোষ, বন্দর, ব্যাংকিং, আইন-শৃঙ্খলার মতো বিষয়গুলো ঐক্যবদ্ধ হয়ে দ্রুততার সঙ্গে আমরা যদি সুরাহা করতে না পারি তাহলে রফতানি প্রবৃদ্ধি ধরে রাখা সম্ভব হবে না। কমার প্রবণতা দেখা যাবে। আমাদের পোশাক খাতে প্রবৃদ্ধির জন্য এখন অনেক বিনিয়োগ দরকার। কারণ চায়না প্লাস ওয়ান ধারার প্রভাবে যুক্তরাষ্ট্রের ক্রেতারা অনেক বড়ভাবে বাংলাদেশে আসতে চাচ্ছে। আমরা যদি এ আগ্রহ ধরে রাখতে না পারি, তাহলে ক্রেতারা আমাদের থেকে বেশি দাম দিয়ে প্রতিবেশী প্রতিযোগী দেশগুলোয় চলে যাবে।’
খাতসংশ্লিষ্টরা বাংলাদেশের বিদ্যমান পরিস্থিতিতে ক্রেতাদের ক্রয়াদেশ সরিয়ে নেয়ার তথ্য জানালেও বড় রফতানিকারকরা এটিকে দেখছেন মৌসুমি প্রেক্ষাপটজনিত বিষয় হিসেবে। যদিও দীর্ঘমেয়াদে ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কার কথাও জানিয়েছেন তারা। সেক্ষেত্রে অস্থিতিশীলতার প্রভাব কাটানো না গেলে ক্রয়াদেশ ভারত ও পাকিস্তানে সরে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে বলে মনে করছেন তারা। ভারত ও পাকিস্তানের সরকারি তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ভারতের পোশাক রফতানির অর্থমূল্য ছিল সাড়ে ১৪ বিলিয়ন ডলার, একই সময়ে পাকিস্তানের পোশাক রফতানির অর্থমূল্য ছিল সাড়ে ১৬ বিলিয়ন ডলার। এ হিসেবে দেশ দুটির গত অর্থবছরের পোশাক রফতানির মোট অর্থমূল্য দাঁড়ায় ৩১ বিলিয়ন ডলারে। এদিকে ইপিবি ও বিজিএমইএর তথ্য অনুযায়ী গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরের ১১ মাসেই বাংলাদেশের পোশাক রফতানির অর্থমূল্য ছিল ৪৪ বিলিয়ন ডলারের বেশি।