কোভিড-১৯ মহামারি, রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যেও শ্রীলঙ্কা ও বাংলাদেশ একটি গুরুত্বপূর্ণ শিল্পকে কেন্দ্র করে নিজেদের পুনরুত্থানের আশা ধরে রেখেছিল—তা হলো তৈরি পোশাক শিল্প, যার প্রধান রপ্তানি গন্তব্য যুক্তরাষ্ট্র।
তবে এই আশার ওপর আঘাত হেনেছে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাম্প্রতিক শুল্ক আরোপের ঘোষণায়।
ট্রাম্প প্রশাসন শ্রীলঙ্কার ওপর ৪৪ শতাংশ এবং বাংলাদেশের ওপর ৩৭ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছে। এই উচ্চ হারে নতুন শুল্ক আরোপে উভয় দেশের পোশাক খাতের ব্যবসায়ীদের মধ্যে উৎকণ্ঠা ছড়িয়ে পড়েছে। কর্মকর্তারা শঙ্কা প্রশমনের চেষ্টা করলেও ব্যবসায়ীরা আশঙ্কা করছেন, তারা হয়তো কম শুল্কপ্রাপ্ত বা অধিক প্রযুক্তিসম্পন্ন দেশের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকতে পারবেন না। ফলে ক্রয়াদেশ অন্যত্র সরে যেতে পারে।
শ্রীলঙ্কার জয়েন্ট অ্যাপারেল অ্যাসোসিয়েশন ফোরামের উপদেষ্টা তুলি কুরে বলেন, ‘৪৪ শতাংশ শুল্ক কোনো ছোটখাটো বিষয় নয়—আমাদের যেন একপ্রকার শোকবার্তা লিখতে হচ্ছে।’
বিশ্বের পোশাকশিল্পে নেতৃস্থানীয় দেশগুলোর ওপর এই শুল্ক চাপ বিশাল প্রভাব ফেলতে পারে। ইক্যুইটি ফার্ম উইলিয়াম ব্লেয়ারের বিশ্লেষণ অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রে যেসব দেশ থেকে তৈরি পোশাক আমদানি হয়, তাদের ওপর গড়ে ৩২ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। এতে শুধু উৎপাদনকারী দেশগুলোর অর্থনীতি নয়, মার্কিন প্রতিষ্ঠান ও ভোক্তারাও ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারেন, কারণ উৎপাদন খরচ প্রায় ৩০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে যেতে পারে।
বাংলাদেশ প্রতিবছর যুক্তরাষ্ট্রে ৭০০ কোটি ডলারের বেশি তৈরি পোশাক রপ্তানি করে, যা দেশটির মোট রপ্তানি আয়ের প্রায় ৮০ শতাংশ। এই শিল্পে কর্মরত ৪০ লাখেরও বেশি শ্রমিকের বেশির ভাগই নারী। তৈরি পোশাক খাত বাংলাদেশের দারিদ্র্য বিমোচনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।
এক বছর আগে বাংলাদেশে বড় ধরনের রাজনৈতিক অস্থিরতার পর স্বৈরশাসকের পতন ঘটে। এরপর থেকে অর্থনীতি স্থিতিশীল করার চেষ্টা চলছে, যেখানে তৈরি পোশাক শিল্প একটি প্রধান ভিত্তি।
বিজিএমইএ-এর সাবেক পরিচালক মহিউদ্দিন রুবেল বলেন, ‘বিশ্ব অর্থনীতি যখন একটু একটু করে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে, ঠিক তখনই এমন সিদ্ধান্ত আমাদের জন্য নতুন অনিশ্চয়তা তৈরি করছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘বাংলাদেশে অনেক পোশাক কারখানা রয়েছে যারা একমাত্র যুক্তরাষ্ট্রের বাজারের জন্য উৎপাদন করে। অনেক কারখানা তাদের উৎপাদনের ৮০ থেকে ১০০ শতাংশই যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি করে। এসব প্রতিষ্ঠানে বিপুল বিনিয়োগ করা হয়েছে শুধু মার্কিন বাজারকে লক্ষ্য করেই। এই শুল্কারোপের সিদ্ধান্ত তাদের জন্য গভীর সংকট তৈরি করবে।’
শ্রীলঙ্কার তৈরি পোশাক শিল্পেও প্রায় সাড়ে তিন লাখ মানুষ কাজ করেন, যাঁরা নাইকি ও ভিক্টোরিয়া’স সিক্রেট-এর মতো বড় ব্র্যান্ডের জন্য পোশাক তৈরি করেন। দেশটির মোট রপ্তানির প্রায় অর্ধেক আসে এই খাত থেকে, যার উল্লেখযোগ্য অংশ যুক্তরাষ্ট্রে যায়। ২০২২ সালে অর্থনৈতিক ধসে পড়ার পর আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ও প্রতিবেশী দেশগুলোর সহায়তায় দেশটি ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করে।
শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক উন্নয়নবিষয়ক উপমন্ত্রী অনিল জয়ন্ত ফার্নান্দো বলেন, ‘আমরা চেষ্টা করছি শুল্ক কার্যকর হওয়ার আগেই যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে কিছুটা ছাড় পাওয়ার সুযোগ আছে কি না, সেটা দেখতে। বিশেষ করে আমাদের বর্তমান কঠিন অবস্থা বিবেচনায় রেখে।’
এই শুল্কারোপের ফলে দুদেশের তৈরি পোশাক খাতের জন্য নতুন চ্যালেঞ্জের সূচনা হলো, যা তাদের ভবিষ্যৎ অর্থনীতিতে গভীর প্রভাব ফেলতে পারে।