ইরানের সঙ্গে ক্রমবর্ধমান উত্তেজনার মধ্যে আলোচনায় এসেছে ইসরায়েলের দীর্ঘদিনের গোপন পারমাণবিক অস্ত্রভাণ্ডার। সুইডেনভিত্তিক থিংক ট্যাংক স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউট (সিপ্রি) জানিয়েছে, ইসরায়েল প্রকাশ্যে পারমাণবিক অস্ত্রের অধিকারী বলে স্বীকার না করলেও, বর্তমানে তারা পারমাণবিক অস্ত্রভাণ্ডার আধুনিকায়নের পথে রয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
গতকাল (১৬ জুন) প্রকাশিত সিপ্রির প্রতিবেদন অনুযায়ী, ইসরায়েলের কাছে বর্তমানে অন্তত ৯০টি পারমাণবিক ওয়ারহেড রয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
গত শুক্রবার (১৩ জুন) ইরানের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ স্থাপনায় হামলা চালায় ইসরায়েল। নাতাঞ্জ, ইসফাহান ও ফরদদৌতে চালানো এই হামলার মধ্য দিয়েই দু’পক্ষের মধ্যে সরাসরি সংঘাত শুরু হয়।
ইসরায়েল দাবি করে, এটি ছিল ইরানের সম্ভাব্য পারমাণবিক অস্ত্র উন্নয়ন রুখতে ‘প্রতিরোধমূলক হামলা’। এরপর থেকে চলমান পাল্টাপাল্টি হামলায় দুই পক্ষের বেসামরিকসহ শতাধিক মানুষ প্রাণ হারিয়েছে।
সিপ্রির হিসাবে, ইসরায়েলের কাছে এমন ৩০টি বিমান, ৫০টি ভূমি থেকে নিক্ষেপযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্র ও ১০টি সমুদ্রভিত্তিক ক্ষেপণাস্ত্র রয়েছে, যেগুলো ৪ হাজার ৪৫০ কিলোমিটার দূরত্ব পর্যন্ত ওয়ারহেড বহনে সক্ষম।
এর পাশাপাশি, ইসরায়েল ডিমোনায় অবস্থিত প্লুটোনিয়াম উৎপাদনকারী স্থাপনাটিও আধুনিকায়ন করছে বলে মনে করছে সংস্থাটি।
আন্তর্জাতিক নীরবতায় সমালোচনা
ইসরায়েলের অঘোষিত পারমাণবিক কর্মসূচি সম্প্রসারিত হতে থাকলেও, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নীরবতা নিয়ে সমালোচনা উঠছে। পশ্চিমা দেশগুলো এই সংঘাতে ইসরায়েলের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে।
গতকাল জি-৭ গোষ্ঠীর এক বিবৃতিতে বলা হয়, ‘এই অঞ্চলের অস্থিতিশীলতা ও সন্ত্রাসের প্রধান উৎস ইরান।’ বিবৃতিতে আরও বলা হয়, ‘পরিষ্কারভাবে জানানো যাচ্ছে যে, ইরানের কখনো পারমাণবিক অস্ত্র থাকার সুযোগ নেই।’
শুক্রবারের হামলার পর মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে জানান, তিনি এবং তার দল আগেই এই হামলার ব্যাপারে জানতেন।
ট্রাম্পের ভাষ্যে, ‘আমরা সব কিছু জানতাম। আমি ইরানকে অপমান ও মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচাতে চেয়েছি। আমি চেয়েছিলাম একটি চুক্তির মাধ্যমে বিষয়টি সমাধান হোক।’
আরব নিউজ এক প্রতিবেদনে জানায়, ‘ইরান যেখানে আন্তর্জাতিক পারমাণবিক অস্ত্র বিস্তাররোধ চুক্তি (এনপিটি)-তে স্বাক্ষরকারী, সেখানে ইসরায়েল তা নয়। ফলে প্রশ্ন উঠেছে—যখন ইসরায়েল ইরানে হামলা চালাচ্ছে একটি এমন পারমাণবিক কর্মসূচি ঠেকাতে, যা আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি সংস্থার (আইএইএ) মতে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য, তখন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় কেন ইসরায়েলের কর্মকাণ্ড নিয়ে প্রশ্ন তুলছে না?’
চলতি বছরের মার্চে, আইএইএ-এর বোর্ড সভায় অস্ট্রিয়ায় নিযুক্ত কাতারের রাষ্ট্রদূত জাসিম ইয়াকুব আল-হাম্মাদি আহ্বান জানান, ইসরায়েলের সব পারমাণবিক স্থাপনাকে সংস্থাটির তদারকির আওতায় আনতে ‘আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টা জোরদার’ করতে। একইসঙ্গে তিনি ইসরায়েলকে ‘অ-পারমাণবিক রাষ্ট্র হিসেবে’ এনপিটি-তে যোগ দেওয়ার আহ্বান জানান।
তবে এসব আন্তর্জাতিক আহ্বান সত্ত্বেও, ইসরায়েল এখনো এনপিটি-তে স্বাক্ষর করেনি এবং আইএইএ-এর সঙ্গে কোনো সহযোগিতাও করছে না।
ইসরায়েল ১৯৮১ সাল থেকে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের ৪৮৭ নম্বর প্রস্তাবেরও লঙ্ঘন করে আসছে। ইরাকের পারমাণবিক গবেষণা কেন্দ্রে ইসরায়েলের হামলার পর এই প্রস্তাব গৃহীত হয়, যেখানে এটিকে জাতিসংঘ সনদ ও আন্তর্জাতিক নিয়মের ‘স্পষ্ট লঙ্ঘন’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়।
প্রস্তাবে ইসরায়েলকে ‘তাৎক্ষণিকভাবে তার পারমাণবিক স্থাপনাগুলোকে আইএইএ-এর তদারকির আওতায় আনার’ আহ্বান জানানো হলেও তা আজও পালন করেনি দেশটি।
আরব নিউজ জানিয়েছে, পারমাণবিক অস্ত্র সংক্রান্ত ইসরায়েলের অবস্থান এখনো ‘অস্পষ্ট’। ১৯৬০-এর দশক থেকে তাদের অবস্থান একই রকম রয়েছে। আর তা হল, ‘মধ্যপ্রাচ্যে পারমাণবিক অস্ত্র প্রয়োগে আমরাই প্রথম হব না।’
সিপ্রির তথ্যমতে, ২০২৪ সালে ইসরায়েল একটি ক্ষেপণাস্ত্র ইঞ্জিন পরীক্ষার আয়োজন করে, যা জেরিকো সিরিজের পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্রের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত বলে ধারণা করা হয়।
বাড়ছে বৈশ্বিক পারমাণবিক অস্ত্রভাণ্ডার
সিপ্রির গবেষণা বলছে, বিশ্বের ৯টি পারমাণবিক শক্তিধর দেশ (যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, চীন, ভারত, পাকিস্তান, উত্তর কোরিয়া ও ইসরায়েল) ২০২৪ সালে পুরোনো অস্ত্র আধুনিকীকরণ ও নতুন অস্ত্র সংযোজন করেছে।
সিপ্রির তথ্যমতে, ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে বিশ্বজুড়ে মোট ১২ হাজার ২৪১টি পারমাণবিক ওয়ারহেড ছিল। এর মধ্যে প্রায় ৯ হাজার ৬১৪টি ওয়ারহেড সামরিক মজুদে, অর্থাৎ প্রয়োজনে ব্যবহারের জন্য প্রস্তুত।
এর মধ্যে ৩ হাজার ৯১২টি ক্ষেপণাস্ত্র ও যুদ্ধবিমানে মোতায়েন ছিল, বাকি ওয়ারহেড সংরক্ষণে রাখা হয়েছে। প্রায় ২ হাজার ১০০টি ওয়ারহেড ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রে সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থায় মোতায়েন ছিল, যার প্রায় সবক’টি রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের।
তবে চীন এখন শান্তিকালেও কিছু ক্ষেপণাস্ত্রে ওয়ারহেড বহন করছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
স্নায়ুযুদ্ধের পর থেকে রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র অব্যবহৃত ওয়ারহেড ধ্বংস করায় বৈশ্বিক ওয়ারহেড সংখ্যা কমছিল। তবে সিপ্রি সতর্ক করেছে, ‘এই প্রবণতা উল্টো পথে যেতে পারে। কারণ ধ্বংসের গতি কমেছে, আর নতুন পারমাণবিক অস্ত্র মোতায়েনের গতি বেড়েছে।’