বিশ্বের দরিদ্রতম প্রেসিডেন্টদের অন্যতম উরুগুয়ের সাবেক প্রেসিডেন্ট হোসে মুখিকা আর নেই।
উরুগুয়ে, লাতিন আমেরিকার একটি ছোট অথচ সচেতন জাতির দেশ, আজ শোকাহত। দেশটির সাবেক প্রেসিডেন্ট হোসে মুহিকা আর নেই। মৃত্যুকালে তার বয়স ছিল ৮৯ বছর। বিশ্বব্যাপী ‘সবচেয়ে দরিদ্র প্রেসিডেন্ট’ হিসেবে খ্যাতি পাওয়া এই নেতা কেবল একজন রাজনীতিবিদ ছিলেন না, বরং ছিলেন সাধারণ জীবনযাপনের এক উজ্জ্বল প্রতীক।। তার প্রভাব শুধু লাতিন আমেরিকা নয়, বিশ্বজুড়ে অনুভূত হয়েছে। বর্তমান প্রেসিডেন্ট ইয়ামান্দু অরসি এক্সে শোকবার্তায় লিখেছেন, ‘আমাদের জন্য যা কিছু করেছো, তোমার যে গভীর ভালোবাসা ছিল মানুষের প্রতি- তার জন্য ধন্যবাদ।’ মুখিকা দীর্ঘদিন ধরে খাদ্যনালির ক্যান্সারে ভুগছিলেন। তবে মৃত্যুর নির্দিষ্ট কারণ প্রকাশ করা হয়নি।
বিপ্লবী থেকে রাষ্ট্রপ্রধান:
হোসে মুখিকার জীবন ছিল রূপকথার মতো। তরুণ বয়সে তিনি ছিলেন একটি সশস্ত্র বিপ্লবী সংগঠন টুপামারোসের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। এই সংগঠন ১৯৬০-এর দশকে উরুগুয়ে সরকারের বিরুদ্ধে গোপন প্রতিরোধ অভিযান চালাত। এই সময়ে তিনি চারবার বন্দি হন, গুলিবিদ্ধ হয়ে মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে পৌঁছান এবং দুইবার জেল থেকে পালান। ১৯৭৩ সালে সেনাবাহিনীর অভ্যুত্থানের পর তাকে ‘নয় বন্দির’ একজন হিসেবে চিহ্নিত করে দীর্ঘ ১৪ বছরের কঠোর কারাবন্দি অবস্থায় রাখা হয়। এ সময়ে তিনি মানসিক ভোগান্তির মধ্য দিয়ে গেছেন, এমনকি পিঁপড়ার সঙ্গে কথা বলতেন বলেও জানিয়েছিলেন। তিনি বলেন, প্রেসিডেন্ট হওয়া জীবনের বড় প্রাপ্তি নয়, বরং কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়ার দিনটাই ছিল সবচেয়ে আনন্দের।
এক অনন্য শাসক:
হোসে মুহিকার জীবনের গল্প যেন একটি সিনেমার চিত্রনাট্য। তরুণ বয়সে তিনি ছিলেন এক গেরিলা আন্দোলনকারী। ১৯৬০ ও ৭০ দশকে উরুগুয়ের টুপামারোস বিদ্রোহী গোষ্ঠীর সক্রিয় সদস্য হিসেবে তিনি সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই করেন। এই সময় তিনি একাধিকবার বন্দি হন এবং মোট ১৪ বছর কারাগারে কাটান, যার মধ্যে দীর্ঘ ২ বছর তাকে একটি কূপে বন্দি করে রাখা হয়েছিল—কোনো আলো-হাওয়া ছাড়াই।
কিন্তু কারাগার থেকে বেরিয়ে তিনি লড়াইয়ের কৌশল পাল্টালেন। অস্ত্র ফেলে হাতে তুলে নিলেন গণতন্ত্রের হাতিয়ার—রাজনীতি।
২০০৫ সালে তিনি প্রথমবার মন্ত্রী হন এবং ২০১০ সালে ৭৪ বছর বয়সে উরুগুয়ের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। বিশ্বের চোখে তখনও তিনি অনেকটাই অচেনা। কিন্তু তার শাসনকালেই উরুগুয়ে বৈপ্লবিক সামাজিক সংস্কারের দিকে এগোয়- গর্ভপাত বৈধকরণ, সমলিঙ্গ বিবাহের স্বীকৃতি এবং গাঁজার বাজার রাষ্ট্রীয়ভাবে নিয়ন্ত্রণ- যা তাকে বিশ্বমঞ্চে এক ব্যতিক্রমী নেতায় পরিণত করে।
এক সাধারণ জীবনের রাজনীতিক:
মুখিকা প্রেসিডেন্ট হওয়ার পরেও রাজপ্রাসাদে না থেকে স্ত্রী লুসিয়া টোপোলানস্কির সঙ্গে মাটির ঘরে বসবাস করতেন।
প্রেসিডেন্ট থাকাকালীন মুহিকার জীবনধারা ছিল সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম। তিনি রাষ্ট্রীয় প্রাসাদে না থেকে নিজের ছোট খামারবাড়িতে থাকতেন। রাষ্ট্রপতির জন্য বরাদ্দ বিলাসবহুল গাড়ি ফেলে তিনি ব্যবহার করতেন ১৯৮৭ সালের একটি ভক্সওয়াগেন বিটল। তার মাসিক বেতনের ৯০ শতাংশ তিনি দান করে দিতেন দরিদ্রদের সহায়তায়।গায়ে সাধারণ পোশাক, কোনো অতিরিক্ত নিরাপত্তা ছাড়াই চলাফেরা করতেন।
একটি আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে মুহিকা বলেছিলেন,
“আমি দরিদ্র নই। যারা অনেক কিছু চায়, কিন্তু কখনোই সন্তুষ্ট না—তারা-ই আসলে দরিদ্র।”
সমালোচনা ও উত্তরাধিকার:
যদিও মুখিকার জনপ্রিয়তা ছিল উচ্চমাত্রায় (শতকরা প্রায় ৭০ ভাগ সমর্থন), তার শাসনকাল নিয়ে কিছু বিতর্কও ছিল। তিনি শিক্ষা খাতের সংস্কারকে অগ্রাধিকার দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেও তা বাস্তবায়নে ব্যর্থ হন। তাছাড়া সরকারি ব্যয় বৃদ্ধি এবং বাজেট ঘাটতির কারণে তাকে সমালোচনার মুখে পড়তে হয়। তবে, তিনি কখনও দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত হননি এবং গণতন্ত্রকে কখনও হুমকির মুখে ফেলেননি। ২০২০ সালে তিনি সক্রিয় রাজনীতি থেকে অবসর নেন। কিন্তু তার প্রভাব রাজনৈতিক অঙ্গনে অটুট ছিল। তার রাজনৈতিক উত্তরসূরি ইয়ামান্দু অরসি ২০২৪ সালের নভেম্বর মাসে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন এবং তার দল ফ্রেন্তে আমপ্লিও সংসদে সর্বোচ্চ আসন পায়। ২০২৩ সালে মুখিকা ঘোষণা দেন যে তিনি ক্যান্সারে ভুগছেন। এরপর থেকে মৃত্যু নিয়ে তার মন্তব্যগুলো হয়ে ওঠে আরও দার্শনিক। শেষ সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, মৃত্যু অনিবার্য, এটা বুঝেই জীবনকে উপভোগ করতে হয়। হয়তো মৃত্যু জীবনের লবণের মতোই।
জীবনের শেষ দিনগুলো:
বর্তমান প্রেসিডেন্ট ইয়ামান্দু ওরসি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্স-এ (পূর্বের টুইটার) এক পোস্টে মুহিকার মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করেন। যদিও তাৎক্ষণিকভাবে তার মৃত্যুর নির্দিষ্ট কারণ জানানো হয়নি, তবে দীর্ঘদিন ধরে তিনি খাদ্যনালীর ক্যানসারে ভুগছিলেন বলে পারিবারিক ও রাজনৈতিক সূত্র জানিয়েছে।
প্রেম, পরিবার ও দর্শন:
হোসে মুহিকার স্ত্রী লুসিয়া টোপোলানস্কি নিজেও একজন রাজনীতিবিদ এবং একসময়ের সহযোদ্ধা। তাঁদের দাম্পত্য ছিল সন্তানের চেয়ে আদর্শে সমৃদ্ধ। দুজনে মিলে একসঙ্গে খামারে কাজ করতেন, সবজি ফলাতেন এবং নিজেদের প্রাত্যহিক জীবনের দায়িত্ব নিজেরাই পালন করতেন।
মুহিকা বিশ্বাস করতেন,
“মানুষকে নেতৃত্ব দিতে হলে প্রথমে মানুষকে ভালোবাসতে হয়।”
একজন ‘দরিদ্র’ প্রেসিডেন্টের মহৎ উত্তরাধিকার:
বিশ্ব রাজনীতির ইতিহাসে খুব কম নেতাই আছেন, যাঁরা ক্ষমতার আসনে থেকেও ক্ষমতাকে অস্বীকার করেছেন। মুহিকা ছিলেন তাঁদের মধ্যে একজন। তিনি প্রমাণ করে গেছেন—ক্ষমতা, বিলাসিতা কিংবা রাজকীয় জীবনধারা নয়; বরং নৈতিকতা, সহানুভূতি এবং সরলতা-ই এক প্রকৃত নেতার পরিচয়।