এশিয়ার সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম; এখানে মূল অর্থনীতিই হলো, কৃষিভিত্তিক।অপরদিকে, অর্থকরী ফসল হিসেবে পাট চাষ ও পাট শিল্পের সঙ্গে আমাদের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি জড়িত।পাট শিল্প হলো বর্তমানে বাংলাদেশের অন্যতম, প্রধান ভারী শিল্প— যা ব্রিটিশ শাসন আমলে এবং পাকিস্তান আমলের একক বৃহত্তম শিল্প।
বর্তমান বিশ্বে, পাট ও পাটজাত দ্রব্যের বৈদেশিক রপ্তানি আয়ের বৃহদাংশই বাংলাদেশের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে— যা মোট বিশ্ব বাজারের প্রায় ৬৫ শতাংশ। আমাদের দেশেই পৃথিবীর সবচেয়ে উন্নতমানের পাট উৎপাদিত হয়।পাটের গুণগত মান এবং এর বহুবিধ ব্যবহার, বিশেষ করে পলিথিনের বিকল্প হিসেবে এই শিল্পকে নতুন করে আলোচনায় নিয়ে এসেছে।

বর্তমান বিশ্ব পরিবেশের জন্য, প্লাস্টিকের ব্যবহার কমানোর দিকে নজর দিচ্ছে। পাটের তৈরি পণ্য, বিশেষ করে পাটের থলে ও ব্যাগ পরিবেশবান্ধব বিকল্প হিসেবে জনপ্রিয়তা লাভ করছে। পাট থেকে তৈরি পণ্যগুলো জীবাণুমুক্ত, পুনরায় ব্যবহারযোগ্য এবং সহজে জীবাণুমুক্ত করা যায়। এই পণ্য প্লাস্টিকের তুলনায় অনেক বেশি নিরাপদ এবং পরিবেশবান্ধব।তবে জলবায়ুর পরিবর্তনে, পাটের উৎপাদনশীলতা ব্যাহত হচ্ছে যা জীববৈচিত্র্য এবং মানব সভ্যতার জন্য সরাসরি হুমকিস্বরূপ।তাই পাটের উৎপাদন,সরবরাহ এবং প্রক্রিয়াজাতকরণের প্রতি যথোপযুক্ত পদক্ষেপ নিতে হবে।
বিগত ২০২৪ অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণে তাকালে দেখা যায় যে,পাট-শিল্পের রপ্তানিতে বেশ বড় ধাক্কা নেমেছিল।দেশে বাধ্যতামূলক পাটের মোড়ক ব্যবহারের আইন বাস্তবায়নের গতিও ছিল ধীর। সব মিলিয়ে চাহিদা কম থাকায় হিমশিম খেয়েছিল পাট ব্যবসায়ীরা।সোনালি আঁশ হিসেবে পরিচিত পাটের চাহিদা কমে যাওয়ায়, বাংলাদেশ জুট স্পিনার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজেএসএ) ৭৭ কারখানার মধ্যে মাত্র দুই ডজন কারখানা পুরোদমে চালু ছিল। ফলে পাটের সুতার উৎপাদন কমেছিল, ৪০ শতাংশ।রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য বলছে, ২০২৩-২৪ অর্থবছর শেষে এই প্রাকৃতিক সুতা থেকে সামগ্রিক রপ্তানি আয় ৪৯২ মিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের (ডিএই) তথ্য অনুসারে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে দেশে পাট উৎপাদন ১৮ শতাংশ কমে ৭৫ লাখ ৬৫ হাজার বেলে (এক বেল প্রায় ১৮২ কেজি) নেমেছে।কল মালিকরা পাটের প্রায় ৮০ শতাংশ প্রক্রিয়াজাত করে বস্তা, ব্যাগ, সুতা ও সুতলি উৎপাদন করে প্রধানত রপ্তানি বাজারের জন্য।
পাটশিল্প বিকাশে যেসব সমস্যা রয়েছে তার মধ্যে অন্যতম হল:
- প্রকৃতির উপর নির্ভরশীলতা: পাট উৎপাদনের জন্য নির্দিষ্ট জলবায়ুর প্রয়োজন হয়। পর্যাপ্ত বৃষ্টি না হলে ফলন কমে যায়। এ অনিশ্চয়তার কারণে কৃষকরা পাট চাষে আগ্রহ হারায়।
- সংগ্রহ প্রণালির জটিলতা: পাট কাটার পর জাগ দেওয়ার প্রক্রিয়া সময়সাপেক্ষ এবং শ্রমনির্ভর। এই কষ্টকর প্রক্রিয়ার কারণে অনেক কৃষক বিকল্প ফসল চাষে ঝুঁকছেন।
- রপ্তানি সমস্যার সমাধান: সময়মতো রপ্তানির অভাব এবং আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতার কারণে পাটের চাহিদা কমে গেছে।
- প্রযুক্তির অভাব: আধুনিক যন্ত্রপাতির অভাবে পাট চাষ প্রাচীন পদ্ধতিতে পরিচালিত হচ্ছে। এটি শ্রমসাধ্য ও সময়সাপেক্ষ।
- কৃষি উপকরণের উচ্চমূল্য: কীটনাশক ও সারের উচ্চমূল্য অনেক কৃষকের ক্রয়সীমার বাহিরে, যা পাটের উৎপাদন ব্যাহত করে।
- কৃষকের বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের অভাব: পাট চাষে বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতির অভাব; ফলন কমার প্রধান কারণগুলোর অন্যতম।
পাটশিল্পের বিকাশের জন্য প্রয়োজন আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার, গবেষণা ও উন্নয়ন এবং কৃষকদের প্রশিক্ষণ। সরকারি এবং বেসরকারি খাতের যৌথ উদ্যোগে পাটের উৎপাদন ও প্রক্রিয়াকরণের ক্ষেত্রে নতুন প্রযুক্তি এবং পদ্ধতির ব্যবহার করলে, এই শিল্প আরো লাভবান হবে।

পাটশিল্প এক সময় দেশের অর্থনীতির মূল ভিত্তি ছিল। কৃষকরা পাট চাষ করে ভালো আয় করতেন। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে প্লাস্টিকের জনপ্রিয়তার কারণে পাটের চাহিদা কমে গিয়েছিল। এখন আবার পাটের প্রতি আগ্রহ বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা কৃষকদের জন্য নতুন সুযোগ সৃষ্টি করছে।
কৃষকদের জন্য প্রয়োজন উন্নত বীজ, সঠিক সার এবং আধুনিক কৃষি প্রযুক্তি। কৃষকদের প্রশিক্ষণ ও সহায়তা প্রদান করলে, তারা আরো বেশি উৎপাদক হতে পারবেন। সরকারি ও বেসরকারি সংস্থাগুলোর উচিত কৃষকদের জন্য, সহজ শর্তে ঋণ প্রদানের ব্যবস্থা করা।
পাটের গুরুত্বকে খুব নগন্য করে দেখার সুযোগ নেই, কারণ মাটির গুণগত মান ও পরিবেশ সংরক্ষণে পাটের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।
একটি সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, পাট উৎপাদন কালে হেক্টরপ্রতি ৫ থেকে ৬ টন পাট পাতা মাটিতে পড়ে। পাটের পাতায় প্রচুর নাইট্রোজেন, ক্যারোটিন, সোডিয়াম, পটাশিয়াম ও ক্যালসিয়াম থাকে। এছাড়া পাট কাটার পর, জমিতে পাটগাছের গোড়াসহ যে শেকড় থেকে যায় তা পরে পচে মাটির সঙ্গে মিশে জৈব সার উৎপাদন করে, এতে পরবর্তী ফসল উৎপাদনের সময় সারের খরচ কম লাগে।
আমাদের দেশে, প্রতিবছর গড়ে ৯৫৬.৩৮ হাজার টন পাট পাতা ও ৪২৩.৪০ হাজার টন পাটগাছের শিকড় মাটির সঙ্গে মিশে যায়, যা জমির উর্বরতা ও মাটির গুনগতমান বৃদ্ধিতে ব্যাপক ভূমিকা রাখে। এ কারণে যে জমিতে পাট চাষ হয়, সেখানে অন্যান্য ফসলের ফলনও ভালো হয়।
শুধু মাটি নয়, বায়ুমণ্ডলকে বিশুদ্ধকরণেও পাটের গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে। পরিবেশবিদগণের মতে, আঁশ উৎপাদনকারী মাঠ ফসল হয়েও, পাট বনভূমির মত পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার্থে ভূমিকা রাখতে পারে। সারাবিশ্বে বছরে প্রায় ৪৭.৬৮ মিলিয়ন টন কাঁচা সবুজ পাটগাছ উৎপাদিত হয়, যার প্রায় ৫.৭২ মিলিয়ন টন কাঁচাপাতা। পাটে কার্বন-ডাই-অক্সাইড শোষণ ক্ষমতা ০.২৩ থেকে ০.৪৪ মিলিগ্রাম। এই কারণে পাট গাছ, পৃথিবীর গ্রিন হাউস গ্যাস ও তার পরিপ্রেক্ষিতে তাপমাত্রা বৃদ্ধিকে কিছুটা হলেও ব্যাহত করে; পৃথিবীকে তার পরিবেশ রক্ষায় সহায়তা করে।
বনের গাছ কেটে মন্ড তৈরি করে কাগজ তৈরি হয়। এক টন কাগজ তৈরি করতে ১৭টি পরিণত গাছ কাটতে হয়। পরিবেশ সুরক্ষার কথা চিন্তা করে, পাটকাঠি দিয়ে স্বল্প ব্যয়ে পেপার পাল্প তৈরি করা যায়। পাটকাঠি জ্বালানির বিকল্প হিসেবে ও পেপার পাল্প তৈরিতে ব্যবহৃত হওয়ায়, বন উজারের হাত থেকে কিছুটা হলেও পরিবেশ রক্ষা পেতে পারে।
তাই দেখা যায় যে,পাটের মধ্যেই লুকিয়ে আছে পরিবেশবান্ধব অর্থনৈতিক সম্ভাবনার নতুন নতুন দিগন্ত। বিশ্বে প্রতিবছর প্রায় ১ ট্রিলিয়ন পলিথিন ব্যবহারের বিরূপ প্রভাব থেকে পরিবেশকে রক্ষা করতে হলে, আমাদের ফিরে যেতে হবে পাটের কাছে।
ভবিষ্যতে পাটশিল্পের উন্নয়ন ও প্রসারের জন্য প্রয়োজন সঠিক পরিকল্পনা ও নীতিমালা। আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার, গবেষণা ও উন্নয়ন এবং আন্তর্জাতিক বাজারে প্রবেশের জন্য, কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করলে পাটশিল্প পুনরায় ; সোনালি ভবিষ্যৎ অর্জন করতে পারবে।