ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে দেশে গত ২৪ ঘণ্টায় আরো পাঁচজনের মৃত্যু হয়েছে। এ নিয়ে চলতি বছরে ডেঙ্গুতে ৩৪২ জনের মৃত্যু হলো। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য মতে, চলতি সপ্তাহেই ডেঙ্গুতে ৩২ জনের মৃত্যু হয়েছে।
গত ২৪ ঘণ্টায় সারা দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে ৪৬৬ জন রোগী। এ নিয়ে চলতি বছরে হাসপাতালে ৬৯ হাজার ৯২২ ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছে। বর্তমানে দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি আছে চার হাজার ৬২৮ ডেঙ্গু রোগী। শুক্রবার (৮ নভেম্বর) স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কন্ট্রোল রুম থেকে পাঠানো নিয়মিত প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানা গেছে।
ডেঙ্গু রোগীর চিকিৎসা দিচ্ছেন এমন একাধিক হাসপাতালের চিকিৎসকরা জানান, ডেঙ্গুজ্বর সাধারণত এক থেকে দুই সপ্তাহের মধ্যে সেরে যায়। কিছু রোগীর ক্ষেত্রে পরিস্থিতি জটিল হতে পারে। ‘হেমারেজিক ফিভার’ হলে ডেঙ্গুতে রোগীর চোখে রক্ত জমে যায়। নাক, দাঁতের মাড়ি থেকে রক্ত ঝরে; মুখ, কান, মলদ্বার এ রকম যে কোনো একটি বা একের অধিক অংশ দিয়ে রক্ত বের হতে পারে। বমি ও কাশির সঙ্গেও রক্ত বের হতে পারে।
অন্যদিকে ‘শক সিনড্রোম’ হলে রোগীর রক্তচাপ ও রক্তের অনুচক্রিকা কমে যায়, অবস্থা দ্রুত খারাপ হয়। এবার ডেঙ্গু আক্রান্ত অধিকাংশ রোগীর শক সিনড্রোম দেখা দিচ্ছে। গত বছর শক সিনড্রোমের রোগী আরও বেশি ছিল। কারও মধ্যে শক সিনড্রোম বা হেমোরজিকের উপসর্গ দেখা দিলে রোগীকে দ্রুত হাসপাতালে নেওয়ার পরামর্শ দেন তারা।
বিশেষজ্ঞরা জানান, ডেঙ্গুর চারটি ধরন (ডেন-১, ডেন-২, ডেন-৩ ও ডেন-৪) রয়েছে। গত জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউিট (আইডিসিআর) ডেঙ্গু পজিটিভ ৮৯টি নমুনা বিশ্লেষণ করে সেখানে প্রায় ৭০ শতাংশ ডেন-২ এর উপস্থিতি পেয়েছে।
পরপর দুই বছর ডেঙ্গুর একই সেরোটাইপ বা ধরনের আধিপত্যের বিষয়ে আইডিসিআরের সায়েন্টিফিক অফিসার (ভাইরোলজি বিভাগ) ডা. আব্দুল্লাহ ওমর নাসিফ বলেন, সাধারণত ডেঙ্গুর একটি সেরোটাইপের প্রাধান্য থাকে তিন থেকে চার বছর। এ সময় বড় একটি সংখ্যক মানুষ এই সেরোটাইপে আক্রান্ত হওয়ার পর তাদের মধ্যে ইমিউনিটি ডেভেলপমেন্ট (রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি) হয়। গত বছর সেরোপটাইপ-২ এর প্রাধান্য দেখা গেছে।
তিনি আরও বলেন, ২০১৩ সাল থেকে আইডিসিআর ডেঙ্গুর সেরোটাইপের ডাটা সংরক্ষণ করছে। দেখা গেছে ২০১৮ সাল পর্যন্ত সেরোটাইপ-২ এর প্রাধান্য ছিল। ২০১৯ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত ছিল সেরোটাইপ-৩। এরপর ২০২৩ থেকে সেরোটাইপ-২ প্রভাব বিস্তার করছে।
ইমেরিটাস অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ বলেন, “আমরা যে কোনো রোগের শুরুতে সতর্ক হই না। ডেঙ্গুজ্বরে প্রথমদিকে সতর্ক না হওয়ায় অনেক রোগী শকে চলে যাচ্ছে। অনেকে যথাসময়ে চিকিৎসা না পেয়ে মারা যাচ্ছেন। এমন পরিস্থিতি থেকে বাঁচতে হলে সবার আগে মশক নিধনে জোর দিতে হবে। কারও জ্বর হলেই বা ডেঙ্গু সন্দেহ হলেই পরীক্ষা করাতে হবে। ডেঙ্গু টেস্টে অবহেলা করা সঠিক সিদ্ধান্ত হবে না।’’
তিনি বলেন, দিনের বেলায় মশার কামড় থেকে বাঁচতে হলে সচেতন হতে হবে। প্রয়োজনে ফুলহাতা জামা-প্যান্ট পরিধান করতে হবে। দিনে বা রাতে ঘুমানোর আগে মশারি টানাতে হবে। কারও সাধারণ জ্বর, সর্দি-কাশির মতো লক্ষণ দেখা দিলে দেরি না করে ডেঙ্গু পরীক্ষা করাতে হবে। এতে রোগ নির্ণয় ও সঠিক চিকিৎসা নেওয়া সহজ হবে। রোগীর ব্যবস্থাপনায় পরিবার থেকে শুরু করে হাসপাতাল সব জায়গায় শতভাগ প্রস্তুতি থাকতে হবে। এজন্য মানুষকে সচেতন হতে হবে।
আইইডিসিআরের উপদেষ্টা ও সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, “ডেঙ্গুর প্রকোপ কমাতে হলে মশা নিধনে গুরুত্ব দিতে হবে। মশা জরিপের ক্ষেত্রে শুধু প্রাকবর্ষা, বর্ষাকাল ও বর্ষাপরবর্তী মশা জরিপ করলে হবে না। সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকে প্রতিদিন সার্ভিলেন্স (নজরদারি) করে এডিস মশা প্রজননে হট স্পস্টগুলো চিহ্নিত করতে হবে। সে অনুযায়ী মশার আবাসস্থল ধ্বংস ও বংশবিস্তার রোধ করতে হবে। ডেঙ্গু রোগীর চিকিৎসাব্যবস্থা বিকেন্দ্রীকরণ করতে হবে।”