ঢাকা , শুক্রবার, ০২ মে ২০২৫, ১৯ বৈশাখ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

নতুন করে শুল্ক আরোপ: যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ বাণিজ্যে নতুন চ্যালেঞ্জ

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশের রপ্তানি পণ্যের ওপর শুল্ক বাড়িয়েছেন। বাংলাদেশের জন্য এই শুল্কহার ১৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে করা হয়েছে ৩৭ শতাংশ। যুক্তরাষ্ট্রের দাবি, তারা যে পদ্ধতিতে শুল্ক নির্ধারণ করেছে, সেটি হচ্ছে—একটি দেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য ঘাটতি বিবেচনা করে আমদানির পরিমাণ দিয়ে ভাগ করে একটি হার নির্ধারণ করা, এবং তার অর্ধেক হারে শুল্ক বসানো। বাংলাদেশের বেলায় এই হার দাঁড়ায় ৭৪ শতাংশ, ফলে শুল্ক নির্ধারিত হয়েছে ৩৭ শতাংশ।

 

২০২৪ সালে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি করেছে প্রায় ৮৩৬ কোটি ডলারের পণ্য, কিন্তু আমদানি করেছে মাত্র ২২১ কোটি ডলারের পণ্য। ফলে বাণিজ্য ঘাটতি দাঁড়ায় ৬১৫ কোটি ডলার। এই ঘাটতি কমাতে হলে বাংলাদেশকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি বাড়ানোর দিকে নজর দিতে হবে।

 

যুক্তরাষ্ট্র থেকে কী আমদানি করে বাংলাদেশ?

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্য মতে, ২০২৪ সালে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি করেছে ২৯১ কোটি ডলারের পণ্য। এর মধ্যে ২৯ কোটি ডলারের পণ্য এসেছে রপ্তানিমুখী শিল্পের কাঁচামাল হিসেবে, যেগুলো শুল্কমুক্ত ছিল। বাকি ২৬২ কোটি ডলারের পণ্য অভ্যন্তরীণ ব্যবহারের জন্য, যার মধ্যে ১৩৩ কোটি ডলারের পণ্যেও কোনো শুল্ক আরোপ হয়নি (যেমন গম, তুলা)। গড় শুল্কহার ছিল ৪.৪৮ শতাংশ।

 

যুক্তরাষ্ট্র থেকে সবচেয়ে বেশি আমদানি হওয়া পণ্যগুলোর মধ্যে রয়েছে:

 

পুরোনো লোহার টুকরা (স্ক্র্যাপ): ৭৭.৮৬ কোটি ডলার (২৭%),

বিউটেন (এলপিজি উপাদান): ৩৩.৩৮ কোটি ডলার,

সয়াবিন বীজ: ৩২ কোটি ডলার (শুল্কমুক্ত),

তুলা: ২৬.৮৭ কোটি ডলার (শুল্কমুক্ত)।

অন্যান্য উল্লেখযোগ্য পণ্যের মধ্যে আছে উড়োজাহাজের ইঞ্জিন, এলএনজি, হুইস্কি, গম, গাড়ি ও কাঠবাদাম।

 

আমদানি বাড়ানো সম্ভব কীভাবে?

ব্যবসায়ীরা মনে করেন, আমদানিতে উৎসাহ বাড়াতে হলে শুল্ক–কর কমাতে হবে, বিশেষত যেসব পণ্য এখনো তুলনামূলক ব্যয়বহুল। আবার সরকারি আমদানিও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। যেমন—বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস ২১.৫ কোটি ডলারের এয়ারক্রাফট ইঞ্জিন আমদানি করেছে।

 

প্যাসিফিক জিন্স গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মোহাম্মদ তানভীর বলেন, আমদানি দ্বিগুণ করা গেলে যুক্তরাষ্ট্রের ঘাটতি হ্রাস পাবে এবং শুল্কহার হয়তো ২৪–২৫ শতাংশে নামিয়ে আনা সম্ভব হবে।

সিপিডির সম্মানীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান মনে করেন, কৃত্রিমভাবে আমদানি বাড়ানোর উদ্যোগ টেকসই নয়। বরং যুক্তরাষ্ট্র থেকে বিনিয়োগ আনা গেলে, সেটিই আমদানির একটি কার্যকর উৎস হতে পারে। তিনি বলেন, দ্বিপক্ষীয় আলোচনার মাধ্যমেই সবচেয়ে ভালো সমাধান সম্ভব। যুক্তরাষ্ট্রে যেসব পণ্য রপ্তানি হয় তা মূলত সাধারণ মানুষের ব্যবহৃত, আর এই পণ্যগুলোতে বেশি শুল্ক আরোপ যুক্তিযুক্ত নয়।

 

তিনি আরও বলেন, ট্রাম্পের প্রস্তাবিত সূত্র বিশ্ব বাণিজ্য ব্যবস্থার জন্য হুমকি হতে পারে। যদি সেই সূত্রে শুল্ক আরোপ করা হয়, তাহলে বাংলাদেশও ভারত ও চীন থেকে আমদানিতে অনেক উচ্চ হারে শুল্ক বসাতে পারে, যা সারা বিশ্বের জন্য অস্থিরতা সৃষ্টি করবে।

 

সারসংক্ষেপে, যুক্তরাষ্ট্রের নতুন শুল্কনীতির কারণে বাংলাদেশের রপ্তানি খাত চাপে পড়েছে। এই চাপ সামলাতে হলে বাংলাদেশকে আমদানি ও বিনিয়োগে কৌশলগত পরিকল্পনা নিতে হবে, এবং একই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে নীতিগত আলোচনার মাধ্যমে সমাধান খুঁজতে হবে।

জনপ্রিয়

নতুন করে শুল্ক আরোপ: যুক্তরাষ্ট্র-বাংলাদেশ বাণিজ্যে নতুন চ্যালেঞ্জ

প্রকাশিত: ০৮:৩০ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ৪ এপ্রিল ২০২৫

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশের রপ্তানি পণ্যের ওপর শুল্ক বাড়িয়েছেন। বাংলাদেশের জন্য এই শুল্কহার ১৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে করা হয়েছে ৩৭ শতাংশ। যুক্তরাষ্ট্রের দাবি, তারা যে পদ্ধতিতে শুল্ক নির্ধারণ করেছে, সেটি হচ্ছে—একটি দেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য ঘাটতি বিবেচনা করে আমদানির পরিমাণ দিয়ে ভাগ করে একটি হার নির্ধারণ করা, এবং তার অর্ধেক হারে শুল্ক বসানো। বাংলাদেশের বেলায় এই হার দাঁড়ায় ৭৪ শতাংশ, ফলে শুল্ক নির্ধারিত হয়েছে ৩৭ শতাংশ।

 

২০২৪ সালে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি করেছে প্রায় ৮৩৬ কোটি ডলারের পণ্য, কিন্তু আমদানি করেছে মাত্র ২২১ কোটি ডলারের পণ্য। ফলে বাণিজ্য ঘাটতি দাঁড়ায় ৬১৫ কোটি ডলার। এই ঘাটতি কমাতে হলে বাংলাদেশকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি বাড়ানোর দিকে নজর দিতে হবে।

 

যুক্তরাষ্ট্র থেকে কী আমদানি করে বাংলাদেশ?

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্য মতে, ২০২৪ সালে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি করেছে ২৯১ কোটি ডলারের পণ্য। এর মধ্যে ২৯ কোটি ডলারের পণ্য এসেছে রপ্তানিমুখী শিল্পের কাঁচামাল হিসেবে, যেগুলো শুল্কমুক্ত ছিল। বাকি ২৬২ কোটি ডলারের পণ্য অভ্যন্তরীণ ব্যবহারের জন্য, যার মধ্যে ১৩৩ কোটি ডলারের পণ্যেও কোনো শুল্ক আরোপ হয়নি (যেমন গম, তুলা)। গড় শুল্কহার ছিল ৪.৪৮ শতাংশ।

 

যুক্তরাষ্ট্র থেকে সবচেয়ে বেশি আমদানি হওয়া পণ্যগুলোর মধ্যে রয়েছে:

 

পুরোনো লোহার টুকরা (স্ক্র্যাপ): ৭৭.৮৬ কোটি ডলার (২৭%),

বিউটেন (এলপিজি উপাদান): ৩৩.৩৮ কোটি ডলার,

সয়াবিন বীজ: ৩২ কোটি ডলার (শুল্কমুক্ত),

তুলা: ২৬.৮৭ কোটি ডলার (শুল্কমুক্ত)।

অন্যান্য উল্লেখযোগ্য পণ্যের মধ্যে আছে উড়োজাহাজের ইঞ্জিন, এলএনজি, হুইস্কি, গম, গাড়ি ও কাঠবাদাম।

 

আমদানি বাড়ানো সম্ভব কীভাবে?

ব্যবসায়ীরা মনে করেন, আমদানিতে উৎসাহ বাড়াতে হলে শুল্ক–কর কমাতে হবে, বিশেষত যেসব পণ্য এখনো তুলনামূলক ব্যয়বহুল। আবার সরকারি আমদানিও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। যেমন—বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস ২১.৫ কোটি ডলারের এয়ারক্রাফট ইঞ্জিন আমদানি করেছে।

 

প্যাসিফিক জিন্স গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মোহাম্মদ তানভীর বলেন, আমদানি দ্বিগুণ করা গেলে যুক্তরাষ্ট্রের ঘাটতি হ্রাস পাবে এবং শুল্কহার হয়তো ২৪–২৫ শতাংশে নামিয়ে আনা সম্ভব হবে।

সিপিডির সম্মানীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান মনে করেন, কৃত্রিমভাবে আমদানি বাড়ানোর উদ্যোগ টেকসই নয়। বরং যুক্তরাষ্ট্র থেকে বিনিয়োগ আনা গেলে, সেটিই আমদানির একটি কার্যকর উৎস হতে পারে। তিনি বলেন, দ্বিপক্ষীয় আলোচনার মাধ্যমেই সবচেয়ে ভালো সমাধান সম্ভব। যুক্তরাষ্ট্রে যেসব পণ্য রপ্তানি হয় তা মূলত সাধারণ মানুষের ব্যবহৃত, আর এই পণ্যগুলোতে বেশি শুল্ক আরোপ যুক্তিযুক্ত নয়।

 

তিনি আরও বলেন, ট্রাম্পের প্রস্তাবিত সূত্র বিশ্ব বাণিজ্য ব্যবস্থার জন্য হুমকি হতে পারে। যদি সেই সূত্রে শুল্ক আরোপ করা হয়, তাহলে বাংলাদেশও ভারত ও চীন থেকে আমদানিতে অনেক উচ্চ হারে শুল্ক বসাতে পারে, যা সারা বিশ্বের জন্য অস্থিরতা সৃষ্টি করবে।

 

সারসংক্ষেপে, যুক্তরাষ্ট্রের নতুন শুল্কনীতির কারণে বাংলাদেশের রপ্তানি খাত চাপে পড়েছে। এই চাপ সামলাতে হলে বাংলাদেশকে আমদানি ও বিনিয়োগে কৌশলগত পরিকল্পনা নিতে হবে, এবং একই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে নীতিগত আলোচনার মাধ্যমে সমাধান খুঁজতে হবে।