ভারতের আদানি গ্রুপকে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ রপ্তানির ক্ষেত্রে প্রায় সাড়ে চার হাজার কোটি টাকার শুল্ক ও কর ফাঁকির সুযোগ করে দেওয়ার অভিযোগে অনুসন্ধানে নেমেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। অভিযোগ রয়েছে, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) অনুমোদন ছাড়াই বিদ্যুৎ খাতের চুক্তিতে শুল্ক ছাড় দেওয়া হয়, যার মাধ্যমে আদানি গ্রুপকে বিশাল অঙ্কের আর্থিক সুবিধা দেওয়া হয়েছে।
এই কর ফাঁকির নেপথ্যে ছিলেন তৎকালীন বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সচিব ও পরে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী আহমদ কায়কাউস। এ কাজে বিদ্যুৎ বিভাগ ও বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)-এর একাধিক কর্মকর্তা জড়িত ছিলেন বলেও অভিযোগ উঠেছে।
দুদকের উপপরিচালক রেজাউল করিম ১৬ এপ্রিল পিডিবিকে চিঠি দিয়ে আদানি চুক্তির যাবতীয় রেকর্ডপত্র, শুল্ক ও কর সম্পর্কিত তথ্য পাঁচ কর্মদিবসের মধ্যে সরবরাহ করতে বলেন। তবে নির্ধারিত সময় পেরিয়ে গেলেও পিডিবি কোনো তথ্য দেয়নি, যার ফলে অনুসন্ধান কার্যক্রমে বড় ধরনের বিঘ্ন ঘটছে।
রেজাউল করিম বলেন, “আমরা প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহে কাজ করছি। সব দপ্তর থেকে তথ্য পেলে বিষয়টি বিশ্লেষণ করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
এনবিআরের কাস্টমস গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের তদন্তে দেখা গেছে, আদানি গ্রুপ বাংলাদেশে বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরু করলেও আমদানি প্রক্রিয়ায় ‘বিল অব এন্ট্রি’ দাখিলের নিয়ম অনুসরণ করা হয়নি। এমনকি শুল্ক ফাঁকির বিষয়টি আইনানুগ প্রক্রিয়ায় নিষ্পত্তিরও উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।
তদন্ত অনুযায়ী, ২০২৩ সালের ৯ মার্চ থেকে ২০২৪ সালের জুলাই পর্যন্ত আদানির ঝাড়খণ্ডের গড্ডা কেন্দ্র থেকে বাংলাদেশ ১,০৫৮ কোটি কিলোওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি করে। যার মূল্য ১২৮ কোটি ডলার। এই পরিমাণ বিদ্যুৎ আমদানিতে ৩১ শতাংশ শুল্ক ও কর মিলে প্রায় ৩৯ কোটি ৭৩ লাখ ডলার (বাংলাদেশি মুদ্রায় সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকার বেশি) পরিশোধ করার কথা থাকলেও তা করা হয়নি।
২০২২ সালের ১৪ আগস্ট পিডিবি তৎকালীন এনবিআর চেয়ারম্যানের কাছে আদানিকে শুল্ক ও কর ছাড় দেওয়ার আবেদন করে। আবেদনপত্রে ভারতের রাষ্ট্রায়ত্ত বিদ্যুৎ সংস্থা এনটিপিসিকে পূর্বে দেওয়া করছাড়ের উদাহরণ তুলে ধরা হয়। তবে এনবিআরের পক্ষ থেকে আদানি পাওয়ারকে কর ছাড় দেওয়ার কোনো প্রজ্ঞাপন জারি হয়নি। এমনকি চুক্তির সময় এনবিআরের কোনো মতামতও নেওয়া হয়নি।
এ বিষয়ে ২০২৩ সালের ১৩ এপ্রিল বিদ্যুৎ সচিবকে চিঠি দিয়ে মতামত চাইলেও কোনো উত্তর দেওয়া হয়নি বলে এনবিআরের প্রতিবেদনে উল্লেখ রয়েছে।
পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের নানা বিতর্কিত সিদ্ধান্ত ও প্রকল্পের পরিপ্রেক্ষিতে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার বিদ্যুৎ খাতের সব চুক্তি পর্যালোচনায় একটি জাতীয় কমিটি গঠন করে। গত অক্টোবর মাসে গঠিত ওই কমিটি আদানি পাওয়ারসহ ১১টি চুক্তি পুনর্বিবেচনার সিদ্ধান্ত নেয়। এর মধ্যে রয়েছে আদানির ঝাড়খণ্ডের গড্ডা পাওয়ার প্লান্ট থেকে ২৫ বছরের জন্য বিদ্যুৎ ক্রয়ের চুক্তিও।
দুদক বর্তমানে এনবিআরের তদন্ত প্রতিবেদন, আদানি-পিডিবি চুক্তির শর্তাবলি, শুল্ক ছাড়ের আইনি ভিত্তি এবং আমদানি প্রক্রিয়ার সকল নথি পর্যালোচনা করছে। যদি এসব অভিযোগের যথাযথ প্রমাণ পাওয়া যায়, তবে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, চুক্তির নথিপত্র খতিয়ে দেখে প্রকৃত দায়ী ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার লক্ষ্যে দুদক দ্রুত অনুসন্ধান সম্পন্ন করতে চায়।