আজকের যান্ত্রিক ও প্রযুক্তিনির্ভর জীবনে ‘মনোযোগ ধরে রাখা’ যেন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সোশ্যাল মিডিয়ার অগণিত নোটিফিকেশন, দ্রুতগতির জীবনধারা এবং নিরবচ্ছিন্ন ডিজিটাল বার্তাপ্রবাহ আমাদের মনোযোগকে ক্ষণস্থায়ী, অস্থির এবং বিভ্রান্তিকর করে তুলছে।
আধুনিক গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, মানুষের গড় মনোযোগের সময়সীমা আশঙ্কাজনকভাবে কমে এসেছে। বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে এই প্রবণতা আরও প্রকট।
এমন অবস্থায় একজন মানুষ কীভাবে নিজের মনকে স্থির, শান্ত ও একাগ্র রাখবে? প্রযুক্তির প্রলোভন থেকে নিজেকে সরিয়ে কিভাবে মনোযোগকে নিয়ন্ত্রণে আনবে?
এর উত্তর নিহিত আছে সালাতে—যেটি একটি চিরন্তন ইবাদত। যা শুধুমাত্র আধ্যাত্মিক উন্নতির পথ নয়, বরং মানসিক প্রশান্তি ও মনোসংযোগ বৃদ্ধির একটি কার্যকর মাধ্যম।
সালাত হলো একাগ্রতার অনুশীলনের একটি অন্যতম মাধ্যম। সালাত কেবলমাত্র শারীরিক কিছু অনুশীলন নয়, এটি এক ধরণের আধ্যাত্মিক ধ্যান, যেখানে প্রতিটি শব্দ, রুকু, সিজদাহ ও দোয়া মানুষের মনকে একাগ্র করে তোলে।
আল্লাহ তায়ালা বলেন: নিশ্চয়ই সালাত অশ্লীলতা ও মন্দ কাজ থেকে বিরত রাখে। (সূরা আনকাবূত, আয়াত ৪৫)
এই বিরত রাখা কেবল খারাপ কাজ থেকে নয়, বরং মনের অস্থিরতা, দ্বিধা এবং বিক্ষিপ্ত চিন্তা থেকেও। সালাতের মাধ্যমে মানুষ আল্লাহর সামনে দাঁড়ায় বিনয়ভরে, দৃষ্টি থাকে সেজদার স্থানে, মুখে উচ্চারিত হয় কুরআনের আয়াত, আর হৃদয় থাকে আল্লাহর স্মরণে নিবিষ্ট। এই মুহূর্তগুলিকে বলা যায় চরম এক মনোযোগের প্রশিক্ষণ।
আমেরিকান নিউরোসায়েন্টিস্ট Andrew Newberg এবং গবেষক Mark Robert Waldman তাদের প্রখ্যাত বই How God Changes Your Brain–এ উল্লেখ করেছেন, প্রার্থনার সময় মস্তিষ্কের prefrontal cortex সবচেয়ে বেশি সক্রিয় হয়, যা মানসিক স্থিতি, গভীর মনোযোগ ও আবেগ নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করে।
ফলে যারা খুশু ও খুযু সহকারে সালাত আদায় করেন, তাদের মধ্যে মানসিক স্থিরতা, ধৈর্য এবং চিন্তার গভীরতা তুলনামূলকভাবে বেশি দেখা যায়।
আধুনিক বিশ্বে ‘মাইন্ডফুলনেস’ বা সচেতনভাবে বর্তমান মুহূর্তে থাকার চর্চা একধরনের মানসিক থেরাপি হিসেবে বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয়তা পেয়েছে। অনেকেই নিয়মিত মেডিটেশন বা ধ্যানের মাধ্যমে তাদের মনোযোগ বাড়াতে চেষ্টা করেন।
কিন্তু একজন মুসলিমের জন্য প্রতিদিনের ৫ ওয়াক্ত সালাতই হচ্ছে প্রকৃত মাইন্ডফুলনেস—এতে আছে শৃঙ্খলা, নিরবতা, অন্তর্মুখীতা এবং আল্লাহর প্রতি পরম আত্মসমর্পণ।
সালাতের প্রত্যক্ষ কিছু উপকারিতা:
মানসিক প্রশান্তি বৃদ্ধি: যারা নিয়মিত সালাত আদায় করেন, তারা বলেন—পড়াশোনা, কাজ বা দৈনন্দিন ব্যস্ততার মাঝেও এক ধরণের প্রশান্তি অনুভব করেন, যা মনোযোগ ধরে রাখতে সাহায্য করে।
চাপ ও দুশ্চিন্তা হ্রাস: বিভিন্ন ইসলামিক ও সাইকোলজিক্যাল গবেষণায় দেখা গেছে, যারা খুশু সহকারে সালাত আদায় করেন, তাদের মানসিক চাপ তুলনামূলক কম থাকে এবং তারা দুশ্চিন্তা মোকাবেলায় অধিক সক্ষম হন।
ডিজিটাল ডিটক্স: সালাত মানুষের মনকে একধরনের ‘ডিটক্স’ করে তোলে। ৫ ওয়াক্ত সালাত যেন দিনের ৫টি বিরতি, যেখানে মানুষ প্রযুক্তি, ব্যস্ততা ও দুনিয়াবি চিন্তা থেকে সাময়িক মুক্তি পায়।