বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স সম্প্রতি এর প্রকৌশল বিভাগ এবং বিএটিসির প্রশিক্ষক প্রকৌশলীদের জন্য নতুন লাইসেন্স ভাতা চালু করেছে। এ ছাড়া কর্মরত পাইলটদের অবসরের বয়সসীমা তিন বছর বাড়ানো হয়েছে। বিমানের এমন সিদ্ধান্তে প্রতিষ্ঠানটির অভ্যন্তরে অসন্তোষ ও হতাশা দেখা দিয়েছে। যেখানে দীর্ঘদিন ধরে সাধারণ কর্মচারীদের বেতন, সুযোগ-সুবিধা অপরিবর্তিত রয়েছে, সেখানে শুধু প্রকৌশলী ও পাইলটদের জন্য বিশেষ আর্থিক ও চাকরিজীবনের সুবিধা দেওয়াকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন বিভাগের কর্মচারীদের মধ্যে বৈষম্যের অভিযোগ উঠেছে।
চলতি বছরের ১৬ মার্চ বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের প্রশাসন ও মানবসম্পদ পরিদফতর থেকে জারি করা এক আদেশে জানানো হয়, বিমানের প্রকৌশল বিভাগ এবং বিএটিসির প্রশিক্ষক প্রকৌশলীদের জন্য নতুন লাইসেন্স ভাতা চালু করা হয়েছে। এ ভাতা তিনটি স্তরে নির্ধারণ করা হয়েছে- প্রাথমিক লাইসেন্সের জন্য মাসিক বিশ হাজার টাকা, প্রতিটি অতিরিক্ত লাইসেন্সের জন্য মাসিক পনেরো হাজার টাকা এবং সর্বোচ্চ মাসিক লাইসেন্স ভাতা পঞ্চাশ হাজার টাকা। এ ভাতা শুধু নির্দিষ্ট বিমানের ধরনভিত্তিক অনুমোদন বা প্রশিক্ষক স্বীকৃতি পাওয়া প্রকৌশলীদের জন্য প্রযোজ্য হবে। সাধারণ প্রকৌশল বা বেসিক লাইসেন্সের জন্য এ ভাতা প্রযোজ্য হবে না।
বিশেষভাবে উল্লেখ্য, লাইসেন্সপ্রাপ্ত প্রকৌশলী যদি একের অধিক লাইসেন্স অর্জন করে, তা হলে তা ধাপে ধাপে ভাতার আওতায় আসবে, তবে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নতুন লাইসেন্স নিলে কোনো অতিরিক্ত ভাতা প্রযোজ্য হবে না।
এ ছাড়া প্রকৌশলী যেসব বিমানে কাজ করতেন সেগুলোর কার্যক্রম যদি বন্ধ হয়ে যায় (ফেজ আউট), তা হলেও তারা এক বছর পর্যন্ত ওই বিমানের লাইসেন্সের ভিত্তিতে ভাতা পাবেন। তবে বিমানের অন্যান্য প্রকৌশল বিভাগ যেমন প্রকৌশল পরিকল্পনা, গুণগত মান পরিদর্শন বা রক্ষণাবেক্ষণ নিয়ন্ত্রণ শাখার প্রকৌশলীরা এ ভাতা পাবেন না।
অন্যদিকে ২০২৪ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত পরিচালনা পর্ষদের ৩৬১তম সভায় বিমান বাংলাদেশে পাইলট সংকটকে ‘তীব্র সমস্যা’ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। সভায় জানানো হয়, অভিজ্ঞ পাইলটদের অবসরে যাওয়া এবং বিদেশে পেশাগতভাবে চলে যাওয়ার কারণে প্রতিষ্ঠানে বড় ধরনের শূন্যতা তৈরি হয়েছে।
এ সংকট মোকাবিলায় পাইলটদের অবসরের বয়সসীমা ৫৯ থেকে বাড়িয়ে ৬২ বছর করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এ ছাড়া অবসরপ্রাপ্ত অভিজ্ঞ পাইলটদের ফের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের প্রক্রিয়া সহজ করতে একটি বিশেষ নীতিমালা তৈরি হবে।
বিমান সূত্র জানায়, এয়ারক্রাফট সার্টিফাই করা খুবই সেনসিটিভ কাছ। এ কাজ সব ইঞ্জিনিয়ার করতে পারেন না। যারা এ কাজ করেন তাদের লাইসেন্স থাকতে হয়। এ লাইসেন্স দেয় বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ। লাইসেন্সধারী ইঞ্জিনিয়ারদের বেতন সাধারণ ইঞ্জিনিয়ারদের চেয়ে বেশি। এ ছাড়া বিমানে যারা কাজ করেন তাদের বেতন স্কেল সরকারি স্কেলের চেয়ে বেশি। লাইসেন্সধারী ইঞ্জিনিয়ারদের ভাতা বাড়ানোর একটি আদেশ হয়েছে। যাদের একাধিক লাইসেন্স আছে তারা বেশি ভাতা পাবেন। ভাতা দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। কাগজপত্র যাচাই-বাছাই করে দেওয়া হচ্ছে।
বিমানের কর্মরতরা বলছেন, এ দুটি সিদ্ধান্তের পরপরই বিমানের অন্যান্য বিভাগ যেমন যাত্রীসেবা, বিপণন, তথ্যপ্রযুক্তি, প্রশাসন, গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিংসহ অনেক কর্মচারীর মধ্যে অসন্তোষ দেখা দেয়। তারা অভিযোগ করছেন, দীর্ঘদিন ধরে তারা একই বেতনে কাজ করে যাচ্ছেন, অথচ তাদের কোনো ভাতা, ইনসেনটিভ বা পদোন্নতির সুযোগ বাড়ানো হয়নি। অন্যদিকে কিছু নির্দিষ্ট শ্রেণির কর্মীর জন্য একতরফাভাবে নতুন ভাতা ও চাকরির সময়সীমা বাড়ানো হয়েছে।
তারা মনে করেন, এ বৈষম্যমূলক সিদ্ধান্ত বিমানের অভ্যন্তরে একতা ও কর্মস্পৃহা নষ্ট করবে। একই প্রতিষ্ঠানে ভিন্ন আচরণ চর্চা করলে তা দীর্ঘমেয়াদে প্রতিষ্ঠানের পারস্পরিক সহযোগিতা ও পেশাগত নৈতিকতা ক্ষুণ্ন করবে।
মানবসম্পদ ও রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা ব্যবস্থাপনা বিশ্লেষকদের মতে, এ ধরনের একতরফা সুবিধা দেওয়া প্রশাসনিক স্বচ্ছতার পরিপন্থী।
বিমান বাংলাদেশের মতো একটি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানকে টিকিয়ে রাখতে হলে সব স্তরের কর্মীর মধ্যে সাম্য ও ন্যায্যতা বজায় রাখা অত্যন্ত জরুরি। কেবল পাইলট ও প্রকৌশলীদের আর্থিক সুবিধা বাড়িয়ে অন্যদের অবহেলা করলে তা প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরে দ্বন্দ্ব ও অসন্তোষের জন্ম দেবে। প্রতিষ্ঠানটিকে টিকিয়ে রাখতে হলে সব বিভাগের কর্মচারীর দক্ষতা ও অবদানের ভিত্তিতে সমান সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সারা পৃথিবীতেই পাইলটের সংকট রয়েছে। দেশেও এ সংকট রয়েছে। এটি সমাধানে আইকাওর নিয়ম অনুযায়ী বিমান এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
এভিয়েশন বিশেষজ্ঞ কাজী ওয়াহিদুল আলম বলেন, আমাদের দেশে পাইলট সংকট রয়েছে। এ জন্য পাইলটদের অবসরের বয়সসীমা বাড়ানোর যে সিদ্ধান্ত বিমান নিয়েছে তা সঠিক। কারণ এ জন্য আইকাওর নির্দেশনা রয়েছে। এর বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের জনসংযোগ বিভাগের মহাব্যবস্থাপক পদের দায়িত্ব পাওয়া এবিএম রওশন কবীর বলেন, চাকরির পাশাপাশি ট্রেনিং করে পরীক্ষা দিয়ে এ লাইসেন্স নিতে হয়। ইঞ্জিনিয়াররা যেন লাইসেন্স নিতে আগ্রহী হন সে জন্য অন্যান্য দেশেও তাদের ভাতা দেওয়া হয়। এর ফলে দেশে লাইসেন্সধারী ইঞ্জিনিয়ারের সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে। এতে দেশ উপকৃত হবে। এ লাইসেন্সধারী ইঞ্জিনিয়াররা অন্য এয়ারলাইন্সকেও সার্টিফাই করে যার রাজস্ব পায় বিমান। পাইলট সংকট কাটাতেই তাদের অবসরের বয়সসীমা বাড়ানো হয়েছে বলে জানান তিনি।