ঢাকা , রবিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৫, ১৪ বৈশাখ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

সেনা আতঙ্কে হারিয়ে যায় কাশ্মীরি শিশুদের শৈশব

ভারতশাসিত কাশ্মীরের সর্বত্রই বেড়েছে সেনাবাহিনীর উপস্থিতি। ভারতীয় সামরিক বাহিনীর এই ব্যাপক উপস্থিতি সেখানকার শিশুদের শৈশবকে গিলে ফেলছে নিঃশব্দে। স্কুলে যাওয়ার পথে পড়তে হয় সেই সেনাদের তল্লাশির মুখে। খুলে দেখাতে হয় বই ভর্তি ব্যাগ।

মসজিদে নামাজ পড়তে যেতেও পেরোতে হয় চেকপয়েন্ট। খেলার মাঠও নিরাপদ নয় কাশ্মীরে। খেলতে গেলে সেনা নজর পড়লেই শুরু হয় জিজ্ঞাসাবাদ। শিশুদের ব্যাগ, জামা, এমনকি তাদের চলাফেরাকেও দেখা হয় সন্দেহের চোখেই।

কখনো কখনো সহ্য করতে হয় গালাগাল আর চড়-থাপ্পড়ও। গুম হওয়ার আতঙ্কও রয়েছে। সেখানকার শিশুদের শৈশব যেন এক অনাদৃত যুদ্ধের শিকার। স্বাধীন ভারতের অধীনে আজও পদে পদে পরাধীন কাশ্মীরের মুসলিম জনপদ। -এপি।

কাশ্মীরে বেড়ে ওঠা একটি শিশুর জীবনের সংজ্ঞা এখন শুধুই বই, খেলা বা বন্ধুত্ব নয়। বরং প্রতিদিন সেনা চৌকির পাশ দিয়ে হাঁটা, ব্যাগ তল্লাশি, জিজ্ঞাসাবাদ, কিংবা হঠাৎ নিখোঁজ হওয়ার আতঙ্ক। কাশ্মীরের শিশুদের প্রতিদিনের জীবনের ওপর সামরিক দখল কতটা প্রভাব ফেলে তা গভীরভাবে বিশ্লেষণ করেছেন ভারতীয় পণ্ডিত একতা ওজা।

তিনি কাশ্মীরকে একটি ঔপনিবেশিক ও সামরিকশাসিত অঞ্চল হিসাবে চিহ্নিত করেছেন। যেখানে প্রতিটি রাস্তাঘাট, স্কুল এমনকি বাসাবাড়িও ভারতীয় সেনাবাহিনীর নজরদারিতে রয়েছে। সেখানে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত সেনাদের চোখ রাঙানি, তল্লাশি, গালাগাল এবং শারীরিক হেনস্তা নিত্যদিনের রুটিন।

এই বাস্তবতায় বসবাসকারী কিশোর-কিশোরীরা এটাকে অভ্যস্ততায় পরিণত করেছে। যা থেকে জন্ম নিচ্ছে এক নতুন রকমের সাহস। ভয়ের মধ্যেও বেঁচে থাকার সাহস। সেনাবাহিনী যেন তাদের জীবনের প্রতিদিনের বাস্তবতার একটি স্বাভাবিক অংশ হয়ে উঠেছে। সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠেই তারা সেনা দেখছে। রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগেও সেনা।

কাশ্মীরের ইসলামাবাদের ১৪-১৫ বছর বয়সি বেশ কয়েকজন কিশোর-কিশোরী জানিয়েছে, ‘এটাই জীবন! আমরা এখন এই পরিস্থিতির সঙ্গে অভ্যস্ত।’

একইভাবে শ্রীনগরের ১৪-১৫ বছর বয়সিরা এই অনুভূতির প্রতিধ্বনি করে বলেছে, ‘এখন আর আমরা সেনাবাহিনীকে ভয় পাই না। তাদের উপস্থিতিতে আমরা অভ্যস্ত।’

১৭ বছর বয়সি সাবিয়া বলেছে, ‘আমরা চাইলেই তাদের এড়িয়ে যেতে পারি না, তারা সর্বত্রই আছে। আমরা তাদের পাশ দিয়ে নির্ভীকভাবে হেঁটে যাই। তবে আমি এখনো মাঝে মাঝে ভয় পাই। কিন্তু আমার বন্ধু একেবারেই আর ভয় পায় না।’

স্কুলে যাওয়ার পথে প্রতিদিন সেনা চেকপয়েন্ট অতিক্রম করতে হয় ১৪ বছর বয়সি ইর্শাদকে। শুধু বই ভর্তি ব্যাগ থাকলেই চলে না, আইডি কার্ডও দেখাতে হয়। সেনারা প্রতিদিনই তার ব্যাগ তল্লাশি করে বলে জানিয়েছে ইর্শাদ।

গবেষণায় উঠে এসেছে, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক পরিচয় যেমন, দাড়ি রাখা, টুপি পরা ও মসজিদে যাওয়াকে সন্দেহের চোখে দেখে সেনারা। নামাজ শেষে মসজিদ থেকে বের হওয়ার সময় লাইনে দাঁড় করিয়ে মোবাইল ফোন ও পরিচয়পত্র পরীক্ষা করে তারা। আর যাদের কাছে কাগজপত্র থাকে না তাদের সঙ্গে করা হয় দুর্ব্যবহার। এমনকি কখনো কখনো শারীরিক নিপীড়নও।

অনেক কিশোর জানিয়েছে, হাসপাতালে যাওয়া, পরীক্ষায় অংশ নেওয়া এমনকি স্কুলে যেতেও সেনা কনভয়ের কারণে দেরি হয় বা বাধা পেতে হয়। আসিয়াহ জানিয়েছে, ‘আমরা যদি কখনো তাদের বলি যে আমাদের দেরি হয়ে যাচ্ছে। তারা আমাদের স্কুল বাস থামিয়ে দেয়। একবার এ কারণে আমি পরীক্ষা দিতে পারিনি।’ এই সামরিক দমন-পীড়ন তাদের শরীরে, মনে এবং চেতনায় গভীর প্রভাব ফেলে বলে জানিয়েছেন ওজা।

চব্বিশ ঘণ্টা নজরদারি, পরিচয়পত্র দেখানোর চাপ, এবং অকারণে হেনস্তার ভয়ে কাশ্মীরের শিশুরা শৈশব ভুলে যেতে বসেছে। বিশ্ব যেখানে এগিয়ে যাচ্ছে প্রযুক্তি আর শিক্ষায় সেখানে কাশ্মীরি শিশুরা প্রতিদিন যুদ্ধ করছে অস্তিত্বের জন্য। ২০১৯ সালের ৫ আগস্ট কাশ্মীরের বিশেষ মর্যদা তুলে নেয় মোদি সরকার।

তারপর থেকে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে বলে তারা জানিয়েছে। এখন আটক নয়, সরাসরি মেরে ফেলার ভয়ও বেড়েছে। বিশেষ করে বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে ছেলে সন্তানদের একা বের হওয়া । বহু পরিবার এখন ছেলে সন্তানদের মেয়ে সদস্যদের সঙ্গে বাইরে পাঠান যেন কিছুটা নিরাপদ থাকে।

জনপ্রিয়

সেনা আতঙ্কে হারিয়ে যায় কাশ্মীরি শিশুদের শৈশব

প্রকাশিত: ১৭ ঘন্টা আগে
ভারতশাসিত কাশ্মীরের সর্বত্রই বেড়েছে সেনাবাহিনীর উপস্থিতি। ভারতীয় সামরিক বাহিনীর এই ব্যাপক উপস্থিতি সেখানকার শিশুদের শৈশবকে গিলে ফেলছে নিঃশব্দে। স্কুলে যাওয়ার পথে পড়তে হয় সেই সেনাদের তল্লাশির মুখে। খুলে দেখাতে হয় বই ভর্তি ব্যাগ।

মসজিদে নামাজ পড়তে যেতেও পেরোতে হয় চেকপয়েন্ট। খেলার মাঠও নিরাপদ নয় কাশ্মীরে। খেলতে গেলে সেনা নজর পড়লেই শুরু হয় জিজ্ঞাসাবাদ। শিশুদের ব্যাগ, জামা, এমনকি তাদের চলাফেরাকেও দেখা হয় সন্দেহের চোখেই।

কখনো কখনো সহ্য করতে হয় গালাগাল আর চড়-থাপ্পড়ও। গুম হওয়ার আতঙ্কও রয়েছে। সেখানকার শিশুদের শৈশব যেন এক অনাদৃত যুদ্ধের শিকার। স্বাধীন ভারতের অধীনে আজও পদে পদে পরাধীন কাশ্মীরের মুসলিম জনপদ। -এপি।

কাশ্মীরে বেড়ে ওঠা একটি শিশুর জীবনের সংজ্ঞা এখন শুধুই বই, খেলা বা বন্ধুত্ব নয়। বরং প্রতিদিন সেনা চৌকির পাশ দিয়ে হাঁটা, ব্যাগ তল্লাশি, জিজ্ঞাসাবাদ, কিংবা হঠাৎ নিখোঁজ হওয়ার আতঙ্ক। কাশ্মীরের শিশুদের প্রতিদিনের জীবনের ওপর সামরিক দখল কতটা প্রভাব ফেলে তা গভীরভাবে বিশ্লেষণ করেছেন ভারতীয় পণ্ডিত একতা ওজা।

তিনি কাশ্মীরকে একটি ঔপনিবেশিক ও সামরিকশাসিত অঞ্চল হিসাবে চিহ্নিত করেছেন। যেখানে প্রতিটি রাস্তাঘাট, স্কুল এমনকি বাসাবাড়িও ভারতীয় সেনাবাহিনীর নজরদারিতে রয়েছে। সেখানে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত সেনাদের চোখ রাঙানি, তল্লাশি, গালাগাল এবং শারীরিক হেনস্তা নিত্যদিনের রুটিন।

এই বাস্তবতায় বসবাসকারী কিশোর-কিশোরীরা এটাকে অভ্যস্ততায় পরিণত করেছে। যা থেকে জন্ম নিচ্ছে এক নতুন রকমের সাহস। ভয়ের মধ্যেও বেঁচে থাকার সাহস। সেনাবাহিনী যেন তাদের জীবনের প্রতিদিনের বাস্তবতার একটি স্বাভাবিক অংশ হয়ে উঠেছে। সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠেই তারা সেনা দেখছে। রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগেও সেনা।

কাশ্মীরের ইসলামাবাদের ১৪-১৫ বছর বয়সি বেশ কয়েকজন কিশোর-কিশোরী জানিয়েছে, ‘এটাই জীবন! আমরা এখন এই পরিস্থিতির সঙ্গে অভ্যস্ত।’

একইভাবে শ্রীনগরের ১৪-১৫ বছর বয়সিরা এই অনুভূতির প্রতিধ্বনি করে বলেছে, ‘এখন আর আমরা সেনাবাহিনীকে ভয় পাই না। তাদের উপস্থিতিতে আমরা অভ্যস্ত।’

১৭ বছর বয়সি সাবিয়া বলেছে, ‘আমরা চাইলেই তাদের এড়িয়ে যেতে পারি না, তারা সর্বত্রই আছে। আমরা তাদের পাশ দিয়ে নির্ভীকভাবে হেঁটে যাই। তবে আমি এখনো মাঝে মাঝে ভয় পাই। কিন্তু আমার বন্ধু একেবারেই আর ভয় পায় না।’

স্কুলে যাওয়ার পথে প্রতিদিন সেনা চেকপয়েন্ট অতিক্রম করতে হয় ১৪ বছর বয়সি ইর্শাদকে। শুধু বই ভর্তি ব্যাগ থাকলেই চলে না, আইডি কার্ডও দেখাতে হয়। সেনারা প্রতিদিনই তার ব্যাগ তল্লাশি করে বলে জানিয়েছে ইর্শাদ।

গবেষণায় উঠে এসেছে, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক পরিচয় যেমন, দাড়ি রাখা, টুপি পরা ও মসজিদে যাওয়াকে সন্দেহের চোখে দেখে সেনারা। নামাজ শেষে মসজিদ থেকে বের হওয়ার সময় লাইনে দাঁড় করিয়ে মোবাইল ফোন ও পরিচয়পত্র পরীক্ষা করে তারা। আর যাদের কাছে কাগজপত্র থাকে না তাদের সঙ্গে করা হয় দুর্ব্যবহার। এমনকি কখনো কখনো শারীরিক নিপীড়নও।

অনেক কিশোর জানিয়েছে, হাসপাতালে যাওয়া, পরীক্ষায় অংশ নেওয়া এমনকি স্কুলে যেতেও সেনা কনভয়ের কারণে দেরি হয় বা বাধা পেতে হয়। আসিয়াহ জানিয়েছে, ‘আমরা যদি কখনো তাদের বলি যে আমাদের দেরি হয়ে যাচ্ছে। তারা আমাদের স্কুল বাস থামিয়ে দেয়। একবার এ কারণে আমি পরীক্ষা দিতে পারিনি।’ এই সামরিক দমন-পীড়ন তাদের শরীরে, মনে এবং চেতনায় গভীর প্রভাব ফেলে বলে জানিয়েছেন ওজা।

চব্বিশ ঘণ্টা নজরদারি, পরিচয়পত্র দেখানোর চাপ, এবং অকারণে হেনস্তার ভয়ে কাশ্মীরের শিশুরা শৈশব ভুলে যেতে বসেছে। বিশ্ব যেখানে এগিয়ে যাচ্ছে প্রযুক্তি আর শিক্ষায় সেখানে কাশ্মীরি শিশুরা প্রতিদিন যুদ্ধ করছে অস্তিত্বের জন্য। ২০১৯ সালের ৫ আগস্ট কাশ্মীরের বিশেষ মর্যদা তুলে নেয় মোদি সরকার।

তারপর থেকে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়েছে বলে তারা জানিয়েছে। এখন আটক নয়, সরাসরি মেরে ফেলার ভয়ও বেড়েছে। বিশেষ করে বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে ছেলে সন্তানদের একা বের হওয়া । বহু পরিবার এখন ছেলে সন্তানদের মেয়ে সদস্যদের সঙ্গে বাইরে পাঠান যেন কিছুটা নিরাপদ থাকে।