ভারতশাসিত কাশ্মীরের পেহেলগামে মঙ্গলবার ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা ঘটেছে। ২০১৯ সালের পর থেকে সবচেয়ে মারাত্মক ‘জঙ্গি হামলা’ হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে। ওই হামলায় কমপক্ষে ২৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে ভারতীয় সেনা ঝন্টুসহ ২৫ জন এবং একজন নেপালীর মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে।
জওয়ান ঝন্টু ৬ প্যারা এসএফ-এ কর্মরত ছিলেন। শহিদ সেনা কমান্ডো ঝন্টু আলি শেখের লাশ বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ঢুকতে বাধা দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। একইসঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের নোটিশ বোর্ডে ‘কুকুর এবং মুসলমানদের প্রবেশ নিষেধ’ লিখে দেওয়া হয়েছে এমন অভিযোগ তুলেছেন ভারতীয় সাংবাদিক অর্ক ভাদুড়ী।
শুক্রবার নিজের আইডিতে দেওয়া এক পোস্টে এ অভিযোগ তুলেন তিনি।
অর্ক ভাদুড়ী বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের নোটিশ বোর্ডে যারা লিখছেন ‘কুকুর এবং মুসলমানদের প্রবেশ নিষেধ’, তারা ক্যাম্পাসে শহিদ সেনা কমান্ডো ঝন্টু আলি শেখকে ঢুকতে দিতে চান না। নদীয়ার ছেলে ঝন্টু আলি শেখের রক্তের দাগ এখনো উধমপুরের মাটিতে লেগে আছে। পেহেলগামে নৃশংস গণহত্যার পর জঙ্গিদের সঙ্গে লড়াই করতে গিয়ে শহিদ হয়েছেন ঝন্টু৷ আমাদের লজ্জা আমরা এমন একটা দেশে বাস করি যেখানে শহিদ ঝন্টুর ছবি বুকে চেপে ধরে কাঁদতে কাঁদতে মা আকালি বিবি এবং বাবা সাবুর আলিকে বলতে হয়, ‘ছেলে মরে প্রমাণ করল, আমরা কোন দিকে!’ আমাদের লজ্জা আমরা এমন একটা দেশে বাস করি যেখানে ‘কুকুর এবং মুসলমানদের’ প্রবেশ নিষিদ্ধ করার দাবি তোলা লোকজন আসলে লাথি মারে সইদ আদিল হুসেন শাহের রক্তভেজা লাশে। আদিল পর্যটকদের টাট্টু ঘোড়া চড়াতেন। জঙ্গীরা যখন গুলি চালিয়ে পর্যটকদের হত্যা করছে, তখন একজনের হাত থেকে বন্দুক কেড়ে নিতে যান আদিল। গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে যান। এই বীর শহিদ ভারতীয় যুবককেও অপমান করছে উগ্র হিন্দুত্ববাদীরা।’
তিনি বলেন, ‘পেহেলগাম গণহত্যার পর প্রত্যাশিতভাবেই দেশজুড়ে তীব্র মুসলিমবিদ্বেষের চাষ শুরু হয়েছে। আরও একবার সুস্পষ্টভাবে প্রমাণ হলো, সংবিধানে যাই থাক, নরেন্দ্র মোদির ভারত আদতে একটি হিন্দুরাষ্ট্র। সংখ্যালঘু জওয়ানরা দেশের জন্য যতই প্রাণ দিন, মুসলিমদের ‘দেশদ্রোহী’ প্রমাণ করার সংগঠিত প্রচেষ্টা বন্ধ হবে না। কারণ এটাই বিজেপি-আরএসএসের রাজনৈতিক প্রকল্প। ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের ভিত্তি হলো আমাদের সংবিধান । সেই ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ সংবিধান বদলে ফেলার দাবি উঠছে টেলিভিশনের সান্ধ্য খেউড়ের আসরে। অথচ অতিদক্ষিণপন্থি প্রচার-মেশিনগুলোর গায়ে দেশবিরোধী তকমা লাগে না!’
‘কাশ্মীরে নিরস্ত্র পর্যটকদের যে সন্ত্রাসবাদীরা নির্বিচারে গুলি করে হত্যা করেছে, তাদের কোনো ক্ষমা নেই । তারা কাশ্মীরের শত্রু, কাশ্মীরীদের শত্রু, গোটা মানবসভ্যতার দুশমন। কেন্দ্রীয় সরকার দ্রুত সন্ত্রাসবাদ দমন করুক। কঠোর ব্যবস্থা নিক। কিন্তু একইসঙ্গে এই প্রশ্নেরও উত্তর সরকারকে দিতে হবে, পর্যটকদের জন্য পর্যাপ্ত নিরাপত্তার ব্যবস্থা করার দায়িত্ব কার ছিল? সরকারের নয়? নিরাপত্তা গাফিলতির দায় কে নেবেন? কাদের আশ্বাসবাণীতে ভরসা করে পর্যটকরা কাশ্মীরে গিয়েছিলেন?’ উল্লেখ করেন অর্ক ভাদুড়ী।
কাশ্মীরে নৃশংস গণহত্যার দায় মোদিশাহ নেবেন কি এমন প্রশ্ন রেখে ভারতীয় এই সাংবাদিক বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ বার বার বলেছেন, তারা ৩৭০ তুলে দিয়ে সন্ত্রাসবাদের কোমর ভেঙে দিয়েছেন, কাশ্মীর এখন সম্পূর্ণ নিরাপদ। সেই কথায় ভরসা করেই তো মানুষগুলো ভিড় জমিয়েছিলেন কাশ্মীরে! তাহলে কি আমাদের দেশের দণ্ডমুণ্ডের কর্তারা সত্যিটা বলেননি? অতিরঞ্জিত তথ্য দিয়েছিলেন? এই নৃশংস গণহত্যার দায় মোদিশাহ নেবেন না? ২০০৮ সালে যখন ২৬/১১ ঘটেছিল, তখন কিন্তু তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী শিবরাজ পাটিল দায় নিয়ে পদত্যাগ করেছিলেন। এবার কে পদত্যাগ করবেন? কেন করবেন না?
তিনি বলেন, মোদি সরকারের আমলে একটার পর একটা জঙ্গী হামলা হয়েছে-কখনো পাঠানকোটে, কখনো উরিতে, কখনো পুলওয়ামায়। এবার পেহেলগামে একঝাঁক নিরস্ত্র পর্যটকের প্রাণ গেল। সরকার কি নাকে তেল দিয়ে ঘুমোচ্ছিল? নরেন্দ্র মোদি ও অমিত শাহ কি নিহত পর্যটকদের আত্মীয়দের হাহাকার শুনতে পান না? স্বজনহারানো মানুষগুলো বার বার নিরাপত্তার অভাবের কথা বলছেন, দায়ী করছেন কেন্দ্রীয় সরকারকে। এই অপরিসীম ব্যর্থতার দায় নিয়ে নতমস্তকে ক্ষমা চাইবেন না মোদি-শাহ? পদত্যাগ করবেন না?
মোদির সরকারের ব্যর্থতা উল্লেখ করে ভারতীয় সাংবাদিক বলেন, ‘জঙ্গীবাদ রুখতে, জওয়ানদের প্রাণ বাঁচাতে, নাগরিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বার বার ব্যর্থ হয়েছে নরেন্দ্র মোদির সরকার। সেই অপদার্থতা আড়াল করতেই মুসলিমবিদ্বেষের হাওয়া তোলা হচ্ছে। মুসলিমদের হত্যাযোগ্য করে তোলার আয়োজন চলছে। অথচ নৃশংস জঙ্গীহানার পরে গোটা কাশ্মীর প্রতিবাদে ও ধিক্কারে নেমে এসেছে রাজপথে। হাজার হাজার সাধারণ কাশ্মীরী, যাদের অধিকাংশই ধর্মে মুসলমান, প্রাণপণে ধিক্কার জানিয়েছেন সন্ত্রাসবাদীদের। অথচ ঘৃণার কারবারিরা প্রচার করছেন সন্ত্রাসবাদী মানেই মুসলিম। তাই বুঝি? তাহলে মালেগাও বিস্ফোরণ যারা ঘটিয়েছিল, তাদের কী বলবেন? এখন তো সেকুলারদের সরকার নেই, নিখাদ হিন্দুত্ববাদীদের সরকার। সম্প্রতি জাতীয় তদন্ত সংস্থা (এনআইএ) মালেগাও বিস্ফোরণ কাণ্ডে বিজেপি নেত্রী তথা সাবেক সংসদ সাধ্বী প্রজ্ঞা সিং ঠাকুরের মৃত্যুদণ্ডসহ সর্বোচ্চ শাস্তি চেয়ে আদালতের কাছে আবেদন করেছে। সাধ্বী প্রজ্ঞা কি মুসলিম? এই দেশে লস্কর-ই তৈবার যেমন কোনো ঠাঁই নেই, ঠিক তেমনই সাধ্বী প্রজ্ঞারও ঠাঁই নেই। ’
ভারত যেমন হিন্দুর, তেমনি মুসলমানেরও বলে উল্লেখ করে অর্ক ভাদুড়ী বলেন, মাঝেমধ্যে এমন সময় আসে, যখন ঝুঁকি নিতে হয়। ঝুঁকি নিয়েই সত্যের পক্ষে, ন্যায়ের পক্ষে দাঁড়াতে হয়৷ নাহলে নিজের কাছেই খুব ছোট হয়ে যেতে হয়। এখন তেমনই সময়৷ এই দেশটা হিন্দুর, এই দেশটা মুসলমানেরও৷ এই দেশটা বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, জৈন, নাস্তিক-সবার। এই দেশকে স্বাধীন করতে ফাঁসির দড়িতে ঝুলেছেন ভগৎ সিং, ক্ষুদিরাম বসুর মতোই শহিদ আসফাকউল্লা খান। এখনো শহিদ হচ্ছেন ঝন্টু আলি শেখের মতো বীর জওয়ান। এই দেশ ভারতরত্ন মাওলানা আবুল কালাম আজাদের দেশ। যারা এই দেশের প্রাণসত্তাকে খতম করতে চাইছেন, তারা সফল হবেন না। হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে আমরা, ভারতের জনগণ সাংবিধানিক ধর্মনিরপেক্ষতাকে রক্ষা করব।