তিস্তার পানিতে প্লাবিত উত্তরবঙ্গ। মানবেতর জীবন অতিবাহিত করছে লালমনিরহাট,কুড়িগ্রাম, নীলফামারী,গাইবান্ধা ও রংপুরের লাখো মানুষ। টানা বৃষ্টি ও ভারত থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে তিস্তার পানি বৃদ্ধি পেয়ে এরই মধ্যে তলিয়ে গেছে বিস্তীর্ণ এলাকা, রাস্তাঘাট। কোথাও কোথাও দেখা দিয়েছে নদীভাঙন। অনেকেই ঘরবাড়ি ছেড়ে গবাদি পশুসহ প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম নিয়ে সড়ক ও বাঁধে আশ্রয় নিয়েছেন। দেখা দিয়েছে বিশুদ্ধ পানি ও খাদ্য সংকট।
রোববার সন্ধ্যা বিভিন্ন নদনদীর পানি কিছুটা কমেছে। তবে সকালে বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। পানি উন্নয়ন বোর্ড বলেছে, উজানে তিস্তা ব্যারাজ এলাকায় পানিপ্রবাহ কমলেও ভাটি এলাকা কাউনিয়ায় আরও বাড়তে পারে। গতকাল দুপুরে তিস্তার পানি বিপৎসীমার ৩৩ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। শনিবার সন্ধ্যায় পানি ১ সেন্টিমিটার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হলেও রাত ১১টায় বেড়ে বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। এ পয়েন্টে বিপৎসীমা ২৯ দশমিক ৩১ সেন্টিমিটার।
আবহাওয়াবিদরা বলছেন, বছরের সবচেয়ে বেশি বৃষ্টি হয় জুলাইয়ে। এ বছর তুলনামূলক বেশি বৃষ্টি হয়েছে। ফলে এ মৌসুমে দেশের বিভিন্ন স্থানে স্বল্প থেকে মধ্যমেয়াদি বন্যা হয়েছে। জুলাইয়ের পর আগস্ট ও সেপ্টেম্বরে অতিবৃষ্টির কারণে মৌসুম ছাড়াই দীর্ঘমেয়াদি বন্যা হয়েছে। বর্ষাকাল ছাড়া অন্য সময়ের বন্যা বড় চিন্তার কারণ।
লালমনিরহাট সদরের তিস্তা রেলস্টেশনের কাছে রেললাইনে পানি ওঠায় ব্যাহত হয় লালমনিরহাট-ঢাকা ট্রেন চলাচল। দুর্গত এলাকার আমন ও শাকসবজির ক্ষেত তলিয়ে গেছে। ভারতের গজালডোবা ব্যারাজ উন্মুক্ত করে দেওয়ায় পানির চাপ সামলাতে ভাটিতে থাকা তিস্তা ব্যারাজের ৪৪টি গেট খুলে দেয় বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ।
রংপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী আহসান হাবিব জানান, সকাল থেকে তিস্তার পানি বাড়লেও, সন্ধ্যায় নামতে শুরু করে। আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে নদীর পানি বিপৎসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হতে পারে।কুড়িগ্রামে বিপৎসীমার ৩১ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে তিস্তার পানি। রোববার (২৯ সেপ্টেম্বর) সকাল ৯টার দিকে কাউনিয়া পয়েন্টে তিস্তা নদীর পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তবে বিপৎসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে ধরলা, দুধকুমার ও ব্রহ্মপুত্রের পানি।
এদিকে পানি বাড়ায় তিস্তার তীরবর্তী রাজারহাট, উলিপুর ও চিলমারী উপজেলার ৬ ইউনিয়নের চর ও নিম্নাঞ্চলের শতাধিক বসতঘর, কাঁচা সড়ক তালিয়ে গেছে। শুধু রাজারহাট উপজেলায় পানিবন্দি হয়ে পড়েছে অন্তত ৬০০ পরিবার। হঠাৎ পানি বেড়ে যাওয়ায় নদীভাঙন আতঙ্কে রয়েছেন মানুষ। এছাড়া তিন শতাধিক হেক্টর জমির রোপা আমন ও মৌসুমি ফসলের ক্ষেতে পানির নিচে বলে জানিয়েছেন কুড়িগ্রাম কৃষি অফিস।
কৃষক কাদের আলী বলেন, তিন বিঘা জমির আধাপাকা ধান তলিয়ে গেছে। কিছু ধান কাটতে পারলেও বাকি সব পানির নিচে তলিয়ে গেছে। আমার খুব ক্ষতি হয়ে গেল।
আরেক কৃষক আকরাম বলেন, শাক-সবজি ও বাদামক্ষেত পানির নিচে তলিয়ে গেছে। হঠাৎ করে এমন পানি হবে চিন্তাও করতে পারিনি।
‘হামার সারা জীবন এমনে যাইবে। আর যে কয়টা দিন বাঁচমো, সে কয়টা দিনও এমন করি কাটা লাগবে। বাহে, নদীত ভাঙতে ভাঙতে আইজ হামরা নিঃস্ব। সারা জীবন খালি শুনি, আসনো নদী বান্দিবে কিন্তু নদী আর বান্দা হইল না। হামার নদীও বান্দা হইবে না, আর হামার কপালও খুলবে না।’ গতকাল রোববার ক্ষোভের সঙ্গে এসব কথা বলেন রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলার লক্ষ্মীটারী ইউনিয়নের চর বাগেরহাট আবাসন এলাকার বাসিন্দা মজিবর রহমান (৫৪)। জানা গেছে, কয়েক দিনের টানা ভারী বৃষ্টি ও উজানের পাহাড়ি ঢলে তিস্তা নদীর পানি বেড়েছে। এতে বন্যায় রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলায় পানিবন্দী হয়ে পড়েছে প্রায় আড়াই হাজার পরিবার। মজিবর রহমান আরও বলেন, ‘দক্ষিণে বন্যা হইতে খালি ত্রাণ নিয়া দৌড়াদৌড়ি সবার। আর উত্তরের মানুষ হামরা পানিত ডুবি মরলেও কায়ও হামার খবর নেয় না। বাহে, তোরা ছবি তুলি হামার কী করেন?’
কুড়িগ্রাম কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক মো. আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, বন্যায় জেলার প্রায় ৩০০ হেক্টর জমির রোপা আমনক্ষেত পানিতে তলিয়ে গেছে। তবে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ এখনো জানা যায়নি।