৪০ বছরে এমন ব্যবসা সংকটে দেশ পড়েনি

আপলোড সময় : ২১-০৭-২০২৫ ১২:০৮:০৩ পূর্বাহ্ন , আপডেট সময় : ২১-০৭-২০২৫ ১২:০৮:০৩ পূর্বাহ্ন
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শুল্ক আরোপে হতাশায় ধুঁকছেন ব্যবসায়ী ও বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, শিল্পকারখানা, ব্যবসা-বাণিজ্যে এমন খারাপ সময় আর আসেনি। সরকারের পক্ষ থেকে নানা উদ্যোগের কথা বলা হলেও সমাধানের সম্ভাবনা নেই, কারণ সরকার কি করছে তা কারো বোধগম্য নয়। তাই সমস্যা আমরা নিজেরা যেকে এনেছি। একই সঙ্গে কোনো দুর্বল এবং অসমন্বিত সরকারের যদি রাজনৈতিক বৈধতা না থাকে, তাহলে তাদের সফলভাবে দর কষাকষি করার নজির বিরল। আর তাই চল্লিশ বছরের ব্যবসায়িক জীবনে রফতানিখাতে এমন সংকট কখনো দেখেননি বলে মন্তব্য করেছেন দেশের অন্যতম রফতানিকারক, ব্যবসায়ী নেতা, সাবেক সংসদ সদস্য ও হা-মীম গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) এ কে আজাদ। তিনি বলেন, আমরা ব্যবসায়ীরা এই খাতকে সম্মানজনক অবস্থানে নিয়ে এসেছি। কিন্তু এখন হতাশ ও ক্ষুব্ধ।
গতকাল ‘যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শুল্ক: কোন পথে বাংলাদেশ’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে হা-মীম গ্রুপের এমডি এ কে আজাদ এই কথা বলেন। রাজধানীর সোনারগাঁও হোটেলে একটি জাতীয় দৈনিক এই গোলটেবিলের আয়োজন করে। সেখানে দেশের বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ, ব্যবসায়ী ও গবেষকেরা অংশ নিয়েছেন। আলোচনায় যুক্তরাষ্ট্র সরকারের সঙ্গে শুল্ক ইস্যুতে বাংলাদেশ সরকারের আলোচনার কৌশল ও দক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে হতাশা ও ক্ষুদ্ধভাব প্রকাশ করেছেন ব্যবসায়ী ও বিশেষজ্ঞরা।
সম্প্রতি এক ব্র্যান্ড অংশীদারের সঙ্গে বৈঠকের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে হা-মীম গ্রুপের এমডি বলেন, আমার এক বড় ব্র্যান্ড হেড অফিসে ডেকে জানায়, তারা নিজ দেশের সরকারের মাধ্যমে বাংলাদেশ সরকারের অবস্থান বোঝার চেষ্টা করেছে। একই সঙ্গে বড় বড় ব্র্যান্ডগুলো যুক্তরাষ্ট্র সরকারের সঙ্গে চলমান ট্যারিফ নেগোসিয়েশনের বিষয়ে খোঁজখবর রাখছে এবং লবিং করছে। তাদের ভাষ্য-তোমাদের অবস্থান দুর্বল, ভালো ফল আশা করা যাচ্ছে না। যুক্তরাষ্ট্র থেকে এভাবে হতাশার কথা আসছে। এটা শুনে তিনি হতাশ হয়ে পড়েন তিনি।
এই পরিস্থিতিতে এ. কে. আজাদ একাধিক উপদেষ্টাকে ফোন করেন। তিনি বলেন, সবাই বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করেন। পরদিন বাণিজ্য উপদেষ্টা ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠক করেন। এ. কে. আজাদ বলেন, উপদেষ্টা জানান, ৯৫ শতাংশ সমস্যা তারা সমাধান করেছেন। বাকি ৫ শতাংশ নিয়ে তিনি বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে কাজ করছেন। আলোচনায় অংশ নিয়ে ব্যবসায়ীরা কী করবেন। তার যুক্তি-যদি ২ থেকে ৩ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব কমও আসে, কিন্তু ৫ বিলিয়ন বা ৫০০ কোটি ডলারের অতিরিক্ত রফতানি হলে দেশের লাভই বেশি হবে। এই উদ্যোগে তিনি সফল হবেন বলে মনে করেন।
এই পরিস্থিতিতে এ কে আজাদ ক্রেতাদের অবস্থান তুলে ধরেন। তিনি বলেন, আমার এক ক্রেতা ই-মেইলে জানান, আগামী ১ তারিখ থেকে যে প্রোডাক্ট তৈরি করা হবে, সেখানে নতুন ট্যারিফ থাকলে আমি (সরবরাহকারী) কত শতাংশ শেয়ার করব, সেটি তাকে জানানোর জন্য। তবে ১ তারিখ থেকে বাংলাদেশের ওপর যে শুল্ক বসবে, তা সরানো না গেলে শুল্কের ৩৫ শতাংশ আমাকে বহন করতে হবে। এখন প্রশ্ন হলো, আমি সেই শুল্ক কীভাবে বহন করব।
এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি ও যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় পোশাক রফতানিকারক এ কে আজাদ বলেন, ওই ক্রেতার কাছে আমার রফতানি ৮০ মিলিয়ন ডলার। সেখানে আমি ইনকাম করি ১ দশমিক ৩৭ মিলিয়ন ডলার। ৮০ মিলিয়ন ডলার থেকে যদি ৩৫ শতাংশ শেয়ার করি, তাহলে আমার কী থাকবে?
বক্তব্যে ইন্দোনেশিয়ার অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন এ কে আজাদ। তিনি বলেন, আমার ইন্দোনেশিয়ায় এক যৌথ উদ্যোগ আছে। সেখানে সরকার ও ব্যবসায়ীরা একসঙ্গে কাজ করছেন। লবিস্ট নিয়োগ করেছেন, প্রতিটি স্তরে আলোচনা করেছেন। অথচ বাংলাদেশে আমরা এমন সুযোগ পাইনি।
অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আপনারা বলছেন- সাত-আট মাসের জন্য দায়িত্বে আছেন। এরপর চলে যাবেন। কিন্তু তখন আমরা যাব কোথায়? আমাদের কার কাছে ফেলে রাখছেন। এ কে আজাদ বলেন, সবার ধারণা, আমাদের মাথার ওপর একজন আছেন। তিনি এটা ফুঁ দিয়ে দেবেন আর সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। যার জন্য আমাদের কোনোরকম মূল্যায়ন করা হচ্ছে না; কোনো লবিস্ট নিয়োগের চিন্তা করা হচ্ছে না।
গত শনিবার সরকার থেকে জানানো হয়েছে, ইউএসটিআর বা যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য প্রতিনিধির দপ্তর শুল্ক নির্ধারণ করবে না, করবে ট্রাম্প প্রশাসন। সরকারের উদ্দেশে এ কে আজাদ বলেন, আপনারা যদি পারেন, ওই পর্যায়ে কিছু চেষ্টা করেন।
সরকার বলেছে, তাড়াতাড়ি করে লবিস্ট নিয়োগসহ অন্যান্য কাজ শুরু করা হয়েছে। কিন্তু এ কে আজাদ বলেন, এখন আমরা লবিস্ট নিয়োগ করে কত দূর কী করা যাবে, তা আমাদের জানা নাই। বাংলাদেশ এমন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।
এদিকে দেশের ইতিহাসে এই প্রথম কোনো ‘নন-ডিসক্লোজার অ্যাগ্রিমেন্ট’ (এনডিএ) সই হতে দেখেছেন বলে মন্তব্য করেছেন অর্থনীতিবিদ দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। তিনি বলেন, বিষয়টি ইতিহাসে এই প্রথম দেখলাম-একটি বিষয়কে নন-পেপার না করে সরাসরি এনডিএ করা হয়েছে। যার ফলে এটি এখন একটি বাধ্যবাধকতায় পরিণত হয়েছে। এখন যদি বাংলাদেশ কোনো লবিস্ট নিয়োগ করে, তার কাছেও এই তথ্য প্রকাশ করা যাবে না।
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে রেসিপ্রোকাল ট্যারিফ (পারস্পরিক শুল্ক) বিষয়ে সরকারের অবস্থান নিয়ে খানিকটা ব্যঙ্গাত্মক সুরে ড. দেবপ্রিয় বলেন, কর্দমাক্ত জায়গায় নিষ্পাপ সরকার নিয়ে এগুচ্ছি। এমন নিরপরাধ, নির্দোষ আর নিষ্পাপ সরকার আমি আগে দেখিনি। তিনি বলেন, কোনো দুর্বল এবং অসমন্বিত সরকারের যদি রাজনৈতিক বৈধতা না থাকে, তাহলে তাদের সফলভাবে দর কষাকষি করার নজির বিরল।
সরকারকে কেন নিরপরাধ, নির্দোষ ও নিষ্পাপ বলেছেন, এর ব্যাখ্যা দিয়ে ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, আমরা এখানে বসে এত কিছু বুঝি আর ওনারা (সরকারে থাকা ব্যক্তিরা) বোঝেন না, আমার কাছে তো এটি আশ্চর্য লাগে। এ জন্যই বললাম এত নির্দোষ, নিরপরাধ ও নিষ্পাপ সরকার আমি দেখিনি। বর্তমানে (শুল্ক নিয়ে আলোচনায়) আমরা একটা কর্দমাক্ত অবস্থায় রয়েছি। তবে সবাই মিলে ওই ঘাটতি পূরণ করতে পারব, এই ভরসায় আছি।
ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, কোনো দুর্বল সরকার সফল দর-কষাকষি করেছে-ইতিহাসে এ নজির খুব কম। একটি অসমন্বিত (সমন্বয় নেই এমন) সরকার তার সবচেয়ে বড় সুযোগগুলো কাজে লাগাতে পেরেছে-এমন ইতিহাসও খুব নেই। এটি এমন এক সমন্বয়হীন সরকার, যার বিভিন্ন কাজের নেতৃত্বে কে আছেন, এটা বোঝা যায় না। এ ছাড়া এ ধরনের সরকারের রাজনৈতিক বৈধতা না থাকলে সেটিও বড় দুর্বলতার অংশ হয়। বর্তমানে যেহেতু সরকার দুর্বল, সেহেতু শুল্কের আলোচনায় দুর্বলতার ঘাটতি পূরণ করতে বিশেষজ্ঞ ও অংশীজনদের সম্পৃক্ত করা প্রয়োজন ছিল। সেটি হয়নি।
আগের সরকারের সঙ্গে বর্তমান সরকারের একটি পার্থক্য তুলে ধরেন দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। তিনি বলেন, আমি একাধিক সরকারের সঙ্গে কাজ করেছি। আগের সরকারের সমস্যা ছিল তারা হয়তো কোনো বিষয়ে জানত না। এরপর আমরা কিছু নিয়ে গেলে ওনারা বলতেন, ও তাই নাকি? আচ্ছা আমাদের পরামর্শগুলো দেন, বাস্তবায়ন করি। আর এখনকার সরকারের কাছে গেলে তারা বলে, এগুলো তো সব জানি। এসব নিয়ে আপনারা কোনো চিন্তা করবেন না।
তবে ড. দেবপ্রিয় এও মনে করেন, ট্রাম্প প্রশাসনের এই নতুন শুল্কনীতি দীর্ঘমেয়াদে কার্যকর হবে না। কারণ, এটি অবৈজ্ঞানিক। ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ট্রাম্পের পাল্টা শুল্ক আরোপের সিদ্ধান্ত একটা ভুল অর্থনৈতিক নীতির ভিত্তিতে পরিচালিত হচ্ছে। আজ হোক, কাল হোক, এখান থেকে তারা ফিরে যেতে বাধ্য হবে। মার্কিন অর্থনীতিতে মূল্যস্ফীতি শুরু হলে, প্রবৃদ্ধি কমলে, কর্মসংস্থান কমলে এটির উপসর্গ দেখা যাবে। গত মাস পর্যন্ত মার্কিন অর্থনীতিতে সে ধরনের কোনো ধাক্কা আসেনি। তবে আগামী ছয় মাসের মধ্যে এটা আসতে পারে। ফলে এই বিষয়গুলো মাথায় রেখে দর-কষাকষি করতে হবে। তবে সেই পর্যায়ে যাওয়ার আগে অন্তর্বর্তী সময়ের জন্য আমাদের কর্মসংস্থান ও বিনিয়োগকে প্রাধান্য দিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তা সত্ত্বেও এই উদ্যোগকে তিনি বাংলাদেশের জন্য একটি ‘ওয়েক আপ কল’ হিসেবে দেখছেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশ আগামী দিনে কোথায় যাবে, তা নির্ধারণে এই নতুন শুল্ক ব্যবস্থা আমাদের জন্য একটি সতর্কবার্তা। এটা শুধু শুল্ক দিয়ে সমাধান করা যাবে না। বাংলাদেশ আগামী দিনে কোথায় থাকবে, এই ভবিষ্যৎ চিন্তাটা আরেকটু বিস্তৃত পরিসরে করা প্রয়োজন। বিশেষ করে পণ্য বহুমুখীকরণ, উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি এবং প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা তৈরির ক্ষেত্রে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ ইঙ্গিত।
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দর-কষাকষিতে শুল্কের বাইরেও বিভিন্ন অশুল্ক বিষয় রয়েছে উল্লেখ করে ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, এখানে শুধু অর্থনীতি না, এর সঙ্গে রাজনৈতিক-অর্থনীতি ও ভূরাজনীতি জড়িত রয়েছে। ফলে এটিকে যাঁরা শুধু একটা শুল্ক সমস্যা হিসেবে দেখেন, তাঁরা ঠিক দেখছেন না। ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য নিয়ে দর-কষাকষিতে সেবা খাতের বিষয়টি একদমই সামনে আনা হয়নি। উপদেষ্টা থেকে শুরু করে অন্য যাঁরা দর-কষাকষির সঙ্গে যুক্ত আছেন, তাঁদের মুখে এটি নিয়ে কোনো কথা নেই। অথচ এই সেবা খাতের সঙ্গে আমাদের তৈরি পোশাক, ওষুধ ও অন্য রফতানি খাতও জড়িত।
শুল্ক নিয়ে দর-কষাকষিতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে করা গোপনীয়তা (নন ডিসক্লোজার) চুক্তির সমালোচনা করেন দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। তিনি বলেন, গোপনীয়তা চুক্তিতে স্বাক্ষরের পরিবর্তে উচিত ছিল একটি নর্ম পেপার (নীতিগত অবস্থানের পত্র) ইস্যু করা।
আলোচনায় তৈরি পোশাকশিল্পের মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ সভাপতি মামহুমদ হাসান খান বলেছেন, বাংলাদেশি পণ্যে বাড়তি শুল্ক কমানোর দর-কষাকষির জন্য লবিস্ট নিয়োগ করার চেষ্টা করছে। তিনি বলেন, গতকাল (শনিবার) থেকে আমরা লবিস্ট নিয়োগে দৌড়ঝাঁপ শুরু করেছি। তবে লবিস্টদের কাছ থেকে সাড়া কম পাচ্ছি। তার কারণ, অধিকাংশই বিভিন্ন দেশের পক্ষে যুক্ত হয়ে গেছে।
মাহমুদ হাসান খান বলেন, আমি ব্যক্তিগতভাবে তিন দিন আগেও আশাবাদী ছিলাম। যাঁরা সরাসরি দর-কষাকষি করছেন, ওনারা অনানুষ্ঠানিকভাবে বলেছেন, তাঁরা খুবই আত্মবিশ্বাসী। তবে দুই দিন আগে থেকে কানাঘুষা চলছে যে তাঁরা বুঝতে পেরেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য প্রতিনিধি (ইউএসটিআর) পাল্টা শুল্ক কমানোর চূড়ান্ত কর্তৃপক্ষ নয়। ট্রাম্প প্রশাসন হচ্ছে সেই কর্তৃপক্ষ। এটা বুঝতে এত সময় লাগল!
বিজিএমইএ সভাপতি বলেন, আমরা যদি বিষয়টি এক মাস আগে জানতে পারতাম, তাহলে লবিস্ট নিয়োগের প্রক্রিয়াটি শুরু করতে পারতাম। শনিবার থেকে আমরা লবিস্ট নিয়োগে দৌড়ঝাঁপ শুরু করেছি। তবে লবিস্টদের কাছ থেকে সাড়া কম পাচ্ছি। তার কারণ, অধিকাংশই বিভিন্ন দেশের পক্ষে যুক্ত হয়ে গেছে। আমার সংগঠনের পরিচালনা পরিষদের সদস্যরা এ মুহূর্তে এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত হতে নিরুৎসাহিত করছেন। তার কারণ, এটা (দর-কষাকষি) ব্যর্থ হতে যাচ্ছে। আমরা কেন ব্যর্থতার দায়ভার নেব?
মাহমুদ হাসান খান পরিসংখ্যান দিয়ে বলেন, বিজিএমইএ’র ১ হাজার ৩২২টি সদস্য কারখানা যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি পোশাক রফতানি করে। এর মধ্যে ১০০ কারখানার ৯১-১০০ শতাংশ রফতানির গন্তব্য যুক্তরাষ্ট্র। আর ৮২২ কারখানা শূন্য থেকে ২০ শতাংশ রফতানি করে দেশটিতে। তিনি বলেন, আমরা ১ দশমিক ২ শতাংশ থেকে ১ দশমিক ৫ শতাংশ মার্জিন (মুনাফা) ব্যবসা করছি। বাড়তি শুল্ক ২০ শতাংশ হলেও আমরা মনে করব, একটা জায়গায় ভালো। যদি না ভারত, ভিয়েতনাম ও ইন্দোনেশিয়ার পাল্টা শুল্ক আমাদের চেয়ে কম হয়।
বিজিএমইএ সভাপতি বলেন, তৈরি পোশাক রফতানি আমাদের রুটিরুজি। দেরি হয়ে গেলেও আমরা লবিস্ট নিয়োগ করার চেষ্টা করছি। বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান পিআরআইয়ের সঙ্গে আমরা যোগাযোগ করছি। ইতিমধ্যে দুজন লবিস্টের সঙ্গে আমরা যোগাযোগ করেছি। এর মধ্যে একজন সাড়া দিয়েছেন। তিনি বলেন, আমলাতন্ত্রের মধ্যে দড়ি-টানাটানি বন্ধ না হলে বেসরকারি খাত এগোবে না। পাল্টা শুল্কের বিষয়ে ‘স্মার্টলি’ দর-কষাকষি করতে হবে। দুর্ভাগ্যবশত, সরকার কখনোই বেসরকারি খাতকে স্বীকৃতি দেয়নি।
অনুষ্ঠানে লেদার গুডস অ্যান্ড ফুটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অভ বাংলাদেশের সভাপতি সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর বলেন, আমরা কনফিউজড, বাংলাদেশ সরকার ট্যারিফ ইস্যুতে কোন পথে যাচ্ছে। তবে আলোচনায় বাংলাদেশে পিছিয়ে গেছে। যদিও তিনি মনে করেন, আলোচনা ও দর-কষাকষির জায়গা এখনো শেষ হয়ে যায়নি।
নাসিম মঞ্জুর বলেন, আমরা যুক্তরাষ্ট্রে জুতা ও উপকরণ রফতানি করি। এসব পণ্যের জন্য যুক্তরাষ্ট্র একক বৃহত্তম বাজার। সেখানে প্রতিবছর আমাদের প্রায় ৪০ কোটি ডলারের পণ্য রফতানি হয়। নাসিম মঞ্জুর বলেন, তার চেয়েও বড় বিষয়, সেখানে প্রবৃদ্ধি অনেক বেশি। এক বছর আগে যা ছিল ২৮ কোটি ডলার, সেটা এখন হয়ে গেছে প্রায় ৪০ কোটি ডলার। এ ধরনের প্রবৃদ্ধি পৃথিবীর আর কোনো বাজারে আছে বলে জানা নেই।
যুক্তরাষ্ট্রের বাজার সম্পর্কে নাসিম মঞ্জুর বলেন, ইউরোপের বাজারে প্রবৃদ্ধি কমে গেছে, কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রে কমেনি। মাঝে মাঝে আমি খুব ব্যথিত হই, যখন আমাদের বলা হয় নতুন বাজার খুঁজে বের করুন। কিন্তু আমরা কীভাবে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ভোক্তাপণ্যের বাজার ছেড়ে রাতারাতি নতুন বাজার পাব-এটা সম্ভব নয়।
চীন প্রসঙ্গে নাসিম মঞ্জুর বলেন, চীন থেকে কিছু উৎপাদন সরে আসছে। যুক্তরাষ্ট্র চীনের পণ্যে যতই শুল্ক হ্রাস-বৃদ্ধি করুক না কেন, চীনে এ ধরনের শ্রমঘন শিল্প থাকবে না। কারণ, চীন-ই তা চায় না। এই শিল্প স্থানান্তরের সুবিধা বাংলাদেশের পাওয়ার সম্ভাবনা ছিল, এখনো আছে; কিন্তু বাংলাদেশে গত তিন থেকে ছয় মাসে তেমন কোনো পরিবেশ দেখা যায়নি।
পাল্টা শুল্ক নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দর-কষাকষির প্রক্রিয়া নিয়ে সরকারের সমালোচনা করলেন বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজের (বিসিআই) সভাপতি আনোয়ার উল আলম চৌধুরী পারভেজ। দর-কষাকষি আলোচনায় ব্যবসায়ীদের সম্পৃক্ত না করার বিষয়টি নিয়েও তিনি কথা বলেন। তিনি বলেন, সরকার কী করছে বা হালনাগাদ কী অগ্রগতি আছে, তা ব্যবসায়ীরা জানতে পারেননি।
আনোয়ার উল আলম চৌধুরী পারভেজ বলেন, শুল্ক নিয়ে আলোচনা ও দর-কষাকষির ক্ষেত্রে সরকার যদি মনে করে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দর-কষাকষির মাধ্যমে তারা ভারত, ভিয়েতনাম বা কম্বোডিয়ার চেয়ে ভালো সুবিধা আনতে পারবে; ব্যবসায়ীদের সম্পৃক্ত করার দরকার নেই, এ জন্য আমলাতন্ত্রই যথেষ্ট; দর-কষাকষির জন্য যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্য প্রতিনিধি (ইউএসটিআর) একমাত্র জায়গা। তাহলে বলব, আমরা সমস্যা নিজেরাই ডেকে নিয়ে আসছি।
আনোয়ার উল আলম চৌধুরী পারভেজ বলেন, সরকারের প্রথম যে জিনিসটা প্রয়োজন, সেটি হলো মনোভাবের পরিবর্তন। এ পরিবর্তন অত্যন্ত জরুরি। কারণ, আমরা আসলে কী চাই, তা পরিষ্কার করে জানানো। রফতানি খাতটি শুধু বৈদেশিক মুদ্রা আয়েরই মাধ্যম নয়, একই সঙ্গে বৈদেশিক বিনিয়োগ ও বিপুল কর্মসংস্থানও জড়িত। এ বিষয়গুলো মাথায় রাখতে হবে।
আনোয়ার উল আলম চৌধুরী বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দর-কষাকষিতে বেসরকারি খাতের পক্ষ থেকে গত এপ্রিলেই সরকারের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত হওয়ার চেষ্টা করেছি। ওই সময়ে আমরা দেশের বাইরের লবিস্ট ফার্মের সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। আমরা মনে করেছি, এ ধরনের পরিস্থিতিতে অন্য দেশগুলো যা করবে, বাংলাদেশের সেটা করা উচিত। শুল্ক আলোচনায় বিভিন্ন খাতের অংশীজনদের সম্পৃক্ত করতে হবে। তিনি বলেন, ওই সময় (এপ্রিল মাসে) সরকার থেকে বলা হলো তারা (সরকার) চেষ্টা করছে। কিন্তু সরকার কী করছে বা হালনাগাদ কী অগ্রগতি আছে, সেগুলো আমরা জানতে পারিনি।
আনোয়ার উল আলম চৌধুরীর মতে, বর্তমান পরিস্থিতিতে খাত-সংশ্লিষ্ট অংশীজনদের সঙ্গে নিয়ে দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে ভিয়েতনামসহ প্রতিযোগী দেশগুলো কী করছে, তা-ও মাথায় রাখতে হবে। শুল্কের হার যেন শেষ পর্যন্ত প্রতিযোগী দেশগুলোর অন্তত কাছাকাছি থাকে, তা দেখতে হবে।
বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো প্রফেসর ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, পাল্টা শুল্ক নিয়ে সরকার ভেবেছিল, আলাপ-আলোচনা করে সমাধান করে ফেলবে। এ নিয়ে সরকারের একধরনের কৃতিত্ব নেওয়ার মানসিকতা ছিল। দর-কষাকষির সঙ্গে সম্পৃক্ত ব্যক্তিরা ভেবেছিলেন, পাল্টা শুল্ককে ১০ শতাংশ বা শূন্য শতাংশে নামিয়ে আনতে পারবেন। সরকারি পর্যায়ে এমন আত্মবিশ্বাস ও অতি আত্মবিশ্বাসের খেসারত দিচ্ছি।
ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, আমাদের প্রতিযোগী দেশগুলো শুল্ক আলোচনায় কোন অবস্থায় থাকছে, সেটি আমাদের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এ বিষয়ে খেয়াল রাখতে হবে। পাশাপাশি অশুল্ক বাধা ও ভূরাজনৈতিক কৌশলের নানা ইস্যু আছে। সেখানে আমাদের সার্বভৌমত্ব, অন্য দেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক-এসব আমরা কতটুকু করতে পারব, কতটুকু পারব না, তা-ও বিবেচনায় আনতে হবে।
ড. মোস্তাফিজুর রহমানের মতে, বাংলাদেশ পোশাকের অনেক বড় সরবরাহকারী দেশ। এক দিনে এখান থেকে চলে যেতে পারবে না। ক্রেতারা একটা দর-কষাকষির মধ্যে আসতে চাইবেন। এখন দেশের উদ্যোক্তাদের সঙ্গে বিদেশি বড় ক্রেতারা এ বাড়তি শুল্ক কতটুকু সইতে পারবে, তা-ও হিসাবের মধ্যে রাখতে হবে। তাঁরা বাড়তি শুল্ক কিছুটা সইবার ক্ষমতা অবশ্যই রাখেন। এখানে দর-কষাকষি করার জায়গা আছে।
ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের বড় বাজার। এটি যতটুকু সম্ভব ধরে রাখতে হবে। কয়েক বছর ধরে, বিশেষ করে ভারতসহ অনেক দেশ এই বাজারে আসতে চাইছে। তারা এখন সুযোগ কাজে লাগাতে চাইবে।
প্রফেসর মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, আরেকটি বিষয় মাথায় রাখতে হবে, পাল্টা শুল্ক আরোপের বিষয়টি যুক্তরাষ্ট্রের ট্রাম্প প্রশাসন করেছে। ভবিষ্যতে এ ব্যবস্থা কত দিন অব্যাহত থাকবে, সেটা দেখার বিষয়। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্য প্রতিনিধি (ইউএসটিআর) ও ইউএস স্টেট ডিপার্টমেন্ট, এটা আমাদের একটু ভালোভাবে বোঝার ব্যাপার আছে। আমরা এত দিন শুধু ইউএসটিআরের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় ভিত্তিতে আলাপ করলাম। এখন শুনছি, ইউএস স্টেট ডিপার্টমেন্ট এ পাল্টা শুল্ক আলোচনায় বড় অংশীদার। সেখানে আলোচনা করতে হবে, লবিস্ট নিয়োগ করতে হবে।
আলোচনায় বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান বলেন, বাংলাদেশের দর-কষাকষির অভিজ্ঞতা নেই। পাল্টা শুল্ক অন্য দেশের তুলনায় আমাদের দর-কষাকষি হতাশ করেছে। তিনি বলেন, মালয়েশিয়া নন-ডিসক্লোজার অ্যাগ্রিমেন্ট (এনডিএ) থাকা সত্ত্বেও তারা জটিল ইস্যুগুলো নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশীজনের সঙ্গে বৈঠক করছে।
সেলিম রায়হান বলেন, বাংলাদেশের ভূরাজনৈতিক বাস্তবতা জটিল। চীনের সঙ্গে সম্পর্ক যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি ভারতের সঙ্গেও রয়েছে নানা জটিলতা। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের ভূকৌশলগত অবস্থান ও চিন্তাভাবনার সঙ্গে আমাদের ভারসাম্য রক্ষা করতে হয়।
যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শুল্ক আরোপ প্রসঙ্গে সানেম নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান তাঁর প্রারম্ভিক বক্তব্যে বলেন, বিশ্বায়নের এই নতুন পর্বে যেখানে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ও কৌশলগত অংশীদারত্ব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। সেখানে বাংলাদেশকে বুঝতে হবে ভূরাজনৈতিক সুবিধা কোথায় আছে। কোন কোন পণ্যে বা খাতে আমরা যুক্তরাষ্ট্রে ইতিবাচক অবস্থান নিতে পারি। একই সঙ্গে আমরা এমন বিষয় নিয়ে এখানে আলোচনা করছি, যা ভবিষ্যতে বাংলাদেশের অর্থনীতি, বিশেষ করে রফতানিনির্ভর শিল্পের ভবিষ্যৎ নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলবে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে চামড়া, চামড়াজাত পণ্যসহ বেশ কিছু খাত যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে পারে। যুক্তরাষ্ট্র আমাদের একটি বড় রফতানি গন্তব্য এবং সেখানে চলমান আলোচনার ভিত্তিতে বোঝা যাচ্ছে, বাংলাদেশ বাণিজ্য নিয়ে বেশ চাপে রয়েছে।
সেলিম রায়হান তাঁর বক্তব্যে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা (ডব্লিউটিও), পাল্টা শুল্ক (রেসিপ্রোকাল ট্যারিফ) এবং বৈশ্বিক বাণিজ্য কূটনীতি প্রসঙ্গে আলোচনা করেন। তিনি বলেন, ডব্লিউটিও কার্যত অকার্যকর। যুক্তরাষ্ট্র যেভাবে পাল্টা শুল্ক আরোপ করেছে তাতে বোঝা যায়, তারা খুব একটা ডব্লিউটিওর নিয়ম মেনে চলছে না। শুধু যুক্তরাষ্ট্রই নয়, অন্য শক্তিশালী দেশ, যেমন ভারত, ভিয়েতনাম, মালয়েশিয়া ও ব্রাজিল নিজেদের স্বার্থে দ্বিপক্ষীয় আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। তারা কেউই বাস্তবে ডব্লিউটিওকে সেভাবে গুরুত্ব দিচ্ছে না। আপাতত বাংলাদেশের উচিত ডব্লিউটিও-নির্ভরতা না বাড়িয়ে বাস্তব পরিস্থিতি বিবেচনায় এগোনো।
সেলিম রায়হান বলেন, যুক্তরাষ্ট্রে চীনের কিছু পণ্যের ওপর শুল্ক হার অনেক বেশি। কম্বোডিয়ার ক্ষেত্রে ৪০ থেকে ৪৫ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক বসানো হয়েছে। আর বাংলাদেশের জন্য প্রস্তাবিত হার ৩৫। এসব বিষয় আমাদের জন্য খুশির খবর নয়, বরং এগুলো দেখিয়ে দিচ্ছে, আমাদের প্রতিযোগীরা যেমন সুবিধা পেতে পারে, তেমনি আমরাও শুল্ক চাপের শিকার হতে পারি।

সম্পাদকীয় :

লাইসেন্স নং: TRAD/DNCC/013106/2024 বার্তা বিভাগ: [email protected] অফিস: [email protected]

অফিস :

যোগাযোগ: মিরপুর, শেওড়াপাড়া হটলাইন: 09638001009 চাকুরী: [email protected]