ফীচার

শহিদ আজাদ-রুমী গ্রন্থাগার: জাহাঙ্গীরনগরে পাঠচর্চার মুক্ত মঞ্চ

আপলোড সময় : ০৭-০৮-২০২৫ ০৩:৪৮:৩০ পূর্বাহ্ন , আপডেট সময় : ০৭-০৮-২০২৫ ০৩:৪৮:৩০ পূর্বাহ্ন
লেখক: ইরফান ইবনে আমিন পাটোয়ারী, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।


বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে একমাত্র জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় আলাদা স্বতন্ত্রতা বজায় রেখেছে— তার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য এবং শিক্ষার্থীদের উদ্যোগে গঠিত মানবিক বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের জন্য।
 
এই মানবিক ও সমাজসচেতন উদ্যোগগুলোর মধ্যে অন্যতম উজ্জ্বল উদাহরণ হলো— বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বেচ্ছাসেবী সামাজিক সংগঠন "ইচ্ছা" কর্তৃক পরিচালিত (শহিদ আজাদ-রুমী গ্রন্থাগার)। এই গ্রন্থাগার শুধু বইয়ের সংগ্রহশালা নয়, এটি হয়ে উঠেছে আলো ছড়ানো এক উন্মুক্ত বাতিঘর এবং জ্ঞানচর্চা, মুক্তচিন্তা ও সাংস্কৃতিক মনন ও বিকাশের প্রাণকেন্দ্র।
 
২০১৮ সালে প্রতিষ্ঠিত স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন "ইচ্ছা" শুরু থেকেই নিছক দাতব্য নয়, বরং মানবিক মূল্যবোধ, সামাজিক দায়বদ্ধতা ও সাম্যবাদী চিন্তার ভিত্তিতে গড়ে উঠেছে। "জ্ঞান অর্জনই শক্তি" এই দর্শনকে ধারণ করে ইচ্ছা, ২০২২ সালে নির্মাণ করে এক ব্যতিক্রমধর্মী গ্রন্থাগার।
 
যার নামকরণ করা হয়েছে আমাদের জাতীয় ইতিহাসের দুই মহান সূর্যসন্তান, ও গেরিলা যোদ্ধাদের সংগঠন ক্র্যাক প্লাটুন এর সদস্য— শহিদ আজাদ এবং শহিদ শাফী ইমাম রুমী'র স্মৃতিকে শ্রদ্ধা জানিয়ে। এই নামকরণে যেমন রয়েছে ইতিহাস চেতনা, তেমনই রয়েছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে বহন করে চলার স্পষ্ট ঘোষণা।
 
শহিদ আজাদ-রুমী গ্রন্থাগারের মূল লক্ষ্য হলো; পাঠকদের মাঝে একটি উন্মুক্ত ও অংশগ্রহণমূলক পাঠাভ্যাসের পরিসর সৃষ্টি করা। এ গ্রন্থাগারে সদস্য হওয়ার মাধ্যমে যে কেউ এসে বই পড়তে পারেন, বই নিয়ে যেতে পারেন। এটি গ্রন্থাগার ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে এক বিপ্লবাত্মক দৃষ্টান্ত, যেখানে আস্থা, সচেতনতা এবং পাঠকের বিকাশকেই প্রধান চালিকাশক্তি হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
 
এই গ্রন্থাগারের সংগ্রহে রয়েছে সাহিত্যের ক্লাসিক, ইতিহাস, দর্শন, সমাজবিজ্ঞান, রাজনীতি, সায়েন্স ফিকশন, আত্মজীবনী, মুক্তিযুদ্ধ, সমকালীন বিশ্লেষণমূলক রচনাসহ বিভিন্ন সাহিত্যের বিচিত্র সম্ভার।
 
ব্যক্তিগত উদ্যোগে, পাঠক ও স্বেচ্ছাসেবীসহ অনেকেই এখানে বই দান করেন, কেউ কেউ নিজস্ব সংগ্রহে থাকা বিভিন্ন বইও এই গ্রন্থাগারে উৎসর্গ করেছেন। এটি গ্রন্থাগারকে পরিণত করেছে পাঠক এবং দাতা উভয়ের মিলনস্থলে; এটি একটি সাংস্কৃতিক কমিউনিটির ভিত্তি কাঠামো হিসেবে গড়ে উঠেছে, যেখানে পাঠ ও অংশগ্রহণ দুটোই সমান গুরুত্বপূর্ণ।
 
গ্রন্থাগারটি, শুধু বইপাঠে সীমাবদ্ধ নয়। বরং, এটি হয়ে উঠেছে বিকল্প চিন্তা ও চর্চার মুক্ত অঙ্গন। এখানে নিয়মিত আয়োজিত হয় পাঠচক্র, সাহিত্য আড্ডা, বইপড়া কর্মসূচি ও পাঠের আসর। এর ফলে গ্রন্থাগারটি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন স্তরের শিক্ষার্থীদের সাথে সংযোগ তৈরি করেছে, যা একটি আদর্শ গণগ্রন্থাগারের অন্যতম বৈশিষ্ট্য।
 
উল্লেখ্য, আদান-প্রদান সহ প্রতি বছর গড়ে প্রায় ৮০০-১০০০ বই এই গ্রন্থাগার থেকে পাঠকের হাতে পৌঁছে যায়। যাদের বেশিরভাগই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। তারা এখানে এসে শুধু বই নেন না; আলাপ করেন, শোনেন, জানেন এবং নতুন চিন্তার খোরাক খুঁজে নেন।
 
আরেকটি বিশেষ দিক হলো— এই গ্রন্থাগার পরিচালনায় কোনো বেতনভিত্তিক কর্মী নেই। পুরো কার্যক্রম চলে সামাজিক সংগঠন ইচ্ছা'র স্বেচ্ছাসেবীদের মাধ্যমে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাই স্বেচ্ছায় নিজেদের সময়, শ্রম ও মেধা দিয়ে এই পাঠাগারের উন্নয়নে ভূমিকা রেখে চলেছেন। এটি নিঃসন্দেহে একটি অনন্য দৃষ্টান্ত, যেখানে আত্মকেন্দ্রিকতার যুগে কিছু তরুণ-তরুণী নিরলসভাবে কাজ করছে, এক আদর্শ সমাজের স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে।
 
গ্রন্থাগারের অবস্থান বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রস্থলে, কেন্দ্রীয় ক্যাফেটেরিয়া সংলগ্ন এলাকা টিএসসিতে। এটি কেবল ভৌগোলিকভাবে কেন্দ্রস্থলে নয়; বরং মানসিক, সাংস্কৃতিক ও নৈতিক বিবেচনায়ও তা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের হৃদয়স্থলে অবস্থান করছে। অনেক শিক্ষার্থী এ গ্রন্থাগারে এসে, প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে পড়াশোনা শুরু করেন, কেউ কেউ নিজেকে আবিষ্কার করেন ভিন্ন এক জগতে।
 
শহিদ আজাদ-রুমী গ্রন্থাগার তাই একটি প্রতিষ্ঠান নয়, জ্ঞান চর্চার এক উন্মুক্ত বাতিঘর। এটি প্রমাণ করে যে স্বল্প সম্পদের মাধ্যমেও কীভাবে একটি সমাজকে আলোকিত করা যায়, যদি তাতে থাকে— আন্তরিকতা, মানবিকতা ও দায়িত্ববোধ। আজকের বাংলাদেশে যেখানে পাঠাভ্যাস ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে, সেখানে এই গ্রন্থাগার হয়ে উঠেছে প্রতিরোধের মশাল ও একটি ‘উন্মুক্ত বাতিঘর’, যেখান থেকে ছড়িয়ে পড়ে মুক্তির আলো, সহযোগিতার বার্তা এবং চিন্তার খোরাক।
 
এই গ্রন্থাগারের প্রতিটি বই, প্রতিটি দেয়াল, প্রতিটি আলো যেন বলে যায়, "জ্ঞান সীমাবদ্ধ নয়, তা সবার জন্য উন্মুক্ত।" আর এই দর্শনের ধারক ও বাহক হয়ে সামাজিক সংগঠন ইচ্ছা—আমাদের সামনে তুলে ধরেছে একটি সম্ভাবনার পথ, যা আমাদের সকলকেই ভাবায়, অনুপ্রাণিত করে, এবং জিজ্ঞাসা করে, "আমরা কী করছি জ্ঞানের জন্য, সমাজের জন্য, আগামী প্রজন্মের জন্য?"
 
এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হলে আমাদের যেতে হবে শহিদ আজাদ-রুমী গ্রন্থাগারে, বসতে হবে পড়ার টেবিলে, নিজেকে আবিষ্কার করতে হবে বইয়ের জগতে, খুলে নিতে হবে একটি বই, আর দেখতে পাবো— এক পাঠক আলোয় মুখ ডুবিয়ে পড়ছে ইতিহাস, কল্পনা, ও ভবিষ্যতের স্বপ্ন।

সম্পাদকীয় :

লাইসেন্স নং: TRAD/DNCC/013106/2024 বার্তা বিভাগ: [email protected] অফিস: [email protected]

অফিস :

যোগাযোগ: মিরপুর, শেওড়াপাড়া হটলাইন: 09638001009 চাকুরী: [email protected]