
বিশ্বজুড়ে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) প্রযুক্তির ব্যবহার যতই বাড়ছে, ততই বাড়ছে ব্যক্তি পর্যায়ে গোপন নজরদারি নিয়ে উদ্বেগ। আপনার ফোনে প্রতিদিন ব্যবহৃত হচ্ছে নানা অ্যাপ — কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাভিত্তিক চ্যাট অ্যাপ, ভয়েস অ্যাসিস্ট্যান্ট, ভিডিও এডিটর, এমনকি ফাইল স্ক্যানারও। কিন্তু জানেন কি, এসবের অনেকগুলোই আপনার কথা, লেখা, লোকেশন, এমনকি ব্যক্তিগত ডিভাইস স্টোরেজ থেকে তথ্য সংগ্রহ করছে?আর অনেক ক্ষেত্রেই এগুলো হচ্ছে গোপন নজরদারি কার্যক্রমের অংশ।
সর্বশেষ এক গবেষণায় চাঞ্চল্যকরভাবে উঠে এসেছে যে, জনপ্রিয় বেশ কিছু AI অ্যাপ ব্যবহারকারীদের অজান্তেই সংগ্রহ করছে স্পর্শকাতর তথ্য এবং তা তৃতীয় পক্ষের হাতে তুলে দিচ্ছে।
MIT Technology Review এবং Electronic Frontier Foundation (EFF)-এর যৌথ গবেষণায় দেখা যায়, Google Assistant, Siri, Alexa, ChatGPT, Gemini, Claude.ai-এর মতো বহুল ব্যবহৃত অ্যাপগুলো ব্যবহারকারীর ভয়েস কমান্ড, সার্চ অভ্যাস, লোকেশন, এমনকি ব্যক্তিগত কথোপকথনের তথ্য সংরক্ষণ করছে। অনেক অ্যাপ "Wake Word" সক্রিয় না থাকলেও পটভূমিতে মাইক্রোফোনের মাধ্যমে ব্যবহারকারীর শব্দ সংগ্রহ করে রাখছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
বিশ্লেষকদের দাবি, এই ধরনের তথ্য সংগ্রহ কেবল ব্যবহারকারীর আচরণ বিশ্লেষণেই সীমাবদ্ধ নয়—এগুলো ডেটা ব্যাংকে জমা রেখে ভবিষ্যতে বাণিজ্যিক কিংবা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হতে পারে। এর মাধ্যমে ব্যবহারকারীর মানসিক গঠন, চিন্তাভাবনা, এমনকি ধর্মীয় ও রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিও আঁচ করা সম্ভব বলে মত দিয়েছেন সাইবার গোয়েন্দারা।
তথ্য প্রযুক্তিবিদদের মতে, যেসব অ্যাপ ব্যবহারকারীর চেহারা স্ক্যান করে ফিল্টার প্রয়োগ করে কিংবা ভয়েস দিয়ে অপারেট হয়, সেগুলোর মাধ্যমেই মূলত চেহারা ও কণ্ঠস্বরের বায়োমেট্রিক ডেটা সংগ্রহ করা হচ্ছে। একইভাবে AI-ভিত্তিক ডকুমেন্ট স্ক্যানার ও পিডিএফ রিডারগুলো ব্যবহারকারীর ব্যক্তিগত ও ব্যবসায়িক নথিপত্র বিশ্লেষণ করে এমন তথ্য সংরক্ষণ করছে, যা ব্যবসায়িক গোপনীয়তা হুমকির মুখে ফেলতে পারে।
তবে এই বিতর্কিত নজরদারির বিষয়ে প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোর ভিন্নমত রয়েছে। তাদের দাবি, ব্যবহারকারীদের ইনপুট শুধুমাত্র AI মডেল ট্রেনিং ও সেবার মান উন্নয়নের জন্য ব্যবহৃত হয় এবং এতে কোনো ব্যক্তিগত তথ্য নির্দিষ্টভাবে সংরক্ষিত থাকে না। যদিও তাদের গোপনীয়তা নীতিমালার (Privacy Policy) মধ্যে এমন সব ধারা আছে, যা ব্যবহারকারীর তথ্য ব্যবহারের ব্যাপারে প্রায় পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়ে দেয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই পরিস্থিতিতে ব্যবহারকারীদের আরও সচেতন হতে হবে। তারা পরামর্শ দেন, অপ্রয়োজনে অ্যাপগুলোর ক্যামেরা, মাইক্রোফোন ও লোকেশন পারমিশন বন্ধ রাখা, এবং পরিচিত ও স্বীকৃত অ্যাপ ব্যতীত অপরিচিত অ্যাপ ইনস্টল না করার বিষয়ে সতর্কতা অবলম্বনের জন্য।
বিশ্ব এখন যখন AI-এর দখলে ধীরে ধীরে ঢুকে পড়ছে, তখন প্রযুক্তির এই রূপ যে নিছক সুবিধা নয়, বরং একরকম নজরদারি ব্যবস্থার সূচনা—এমন আশঙ্কাই উঠে আসছে সাম্প্রতিক গবেষণাগুলো থেকে।
কী ধরনের তথ্য পাচার হচ্ছে?:
বিশ্লেষণে দেখা গেছে, এই অ্যাপগুলোর অনেকগুলো নিচের তথ্যগুলো একত্র করছে এবং কখনো কখনো প্রক্রিয়াজাত করে বিক্রি করছে:
ভয়েস রেকর্ডিং: AI অ্যাসিস্ট্যান্ট অ্যাপগুলো পুরোপুরি কণ্ঠধ্বনি সংরক্ষণ করে ব্যবহারকারীর স্বর ও টোন বিশ্লেষণ করছে।
লোকেশন ডেটা: অ্যাপ চালু না থাকলেও পটভূমিতে GPS ট্র্যাকিং অনেক ক্ষেত্রে চালু থাকে।
ব্যক্তিগত ডকুমেন্ট: PDF রিডার বা স্ক্যানার অ্যাপ ব্যবহারকারীর ফাইল স্ক্যান করে ক্লাউডে আপলোড করে।
চ্যাট ইনপুট: ChatGPT বা AI চ্যাট অ্যাপগুলোর ইনপুট-আউটপুট সংরক্ষিত থাকে মডেল ট্রেনিংয়ের জন্য।
চেহারার ছবি: ফেস-এডিটিং অ্যাপের মাধ্যমে ব্যবহারকারীর মুখাবয়ব বিশ্লেষণ করে AI ট্রেনিং ডেটাবেসে পাঠানো হয়।
কে পাচ্ছে এই তথ্য?:
এই তথ্য তিন ধরণের প্ল্যাটফর্মে পৌঁছায়
১. AI কোম্পানির নিজস্ব সার্ভার: বিশ্লেষণ ও মডেল উন্নয়নের নামে তারা এগুলো সংরক্ষণ করে।
২. তৃতীয় পক্ষের পার্টনার ও বিজ্ঞাপনদাতা: টার্গেটেড বিজ্ঞাপনের জন্য ব্যবহারকারীর আচরণ ও আগ্রহ বিশ্লেষণ করে বিক্রি করা হয়।
৩. সরকারি নজরদারি ইউনিট: কিছু কোম্পানির নীতিমালায় উল্লেখ রয়েছে, প্রয়োজনে তারা আইন-প্রয়োগকারী সংস্থার সঙ্গে তথ্য শেয়ার করতে পারে। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের Five Eyes জোটের নজরদারির অধীনে থাকা ডেটা বিনিময়ের বিষয়টি নিয়েও উদ্বেগ রয়েছে।
এ বিষয়ে AI কোম্পানিগুলোর বক্তব্য কী?:
প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলো এই অভিযোগগুলো অনেকাংশে স্বীকার করে, তবে তারা দাবি করে, “ব্যবহারকারীর অনুমতিতেই সব ডেটা সংগ্রহ করা হয় এবং তা গোপনীয়তা রক্ষা করে ব্যবহার করা হয় মডেল উন্নয়নের জন্য।”
ChatGPT-এর মূল প্রতিষ্ঠান OpenAI-এর গোপনীয়তা নীতিমালায় বলা হয়েছে:
> “Your conversations may be used to improve our AI systems. Please do not share any sensitive or personally identifiable information.
Google, Amazon, Apple এরাও একই ধরনের স্টেটমেন্ট দিয়ে থাকে। কিন্তু অনেক বিশেষজ্ঞের মতে, এসব নীতিমালায় এত পরিমাণ আইনি ভাষা থাকে যে সাধারণ ব্যবহারকারীর পক্ষে সেটি বোঝা প্রায় অসম্ভব।
তথ্য সুরক্ষায় ব্যবহারকারীর করণীয় কী?:
বিশেষজ্ঞরা নিচের সতর্কতাগুলো মেনে চলার পরামর্শ দেন:
১.অ্যাপ ইনস্টল করার আগে পারমিশন ভালোভাবে যাচাই করুন।
২.অপ্রয়োজনে ক্যামেরা, মাইক্রোফোন, লোকেশন অ্যাক্সেস বন্ধ রাখুন।
৩.গোপনীয় নথিপত্র বা স্পর্শকাতর আলোচনা AI অ্যাপে ইনপুট দেবেন না।
৪.VPN ও Tracker Blocker অ্যাপ ব্যবহার করুন।
৫.Signal, ProtonMail-এর মতো end-to-end encrypted প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করুন।
৬.কোনো অ্যাপের Privacy Policy না পড়ে কখনও ‘Agree’ বাটনে চাপ দেবেন না।
তথ্যসূত্র:
১.MIT Technology Review, August 2025
২.EFF Privacy Index 2024
৩.OpenAI Privacy Policy
৪.Google Privacy Center
৫.Interviews with বাংলাদেশ সাইবার নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ ফোরাম
৬.The Guardian (Tech Investigations), July 2025