মেলখুম গিরিপথ : সর্বশেষ এক বছর আগে আবিষ্কার হয় মেলখুম ট্রেইলের। উপজেলার জোরারগঞ্জ ইউনিয়নের সোনাপাহাড়ের গহীন পাহাড়ের এ গিরিপথ নিয়ে রহস্যের যেন শেষ নেই। কি আছে সেখানে? কেন এতোটা কঠিন পথ পাড়ি দিতে হয় সেখানে যেতে ? দেড় থেকে দুই ঘণ্টা বালি ও পাথরের ঝিরিপথ ধরে হাঁটার পর মিলবে খুমের প্রবেশমুখ। এরপর দুই পাশে দেখা যাবে একশ থেকে দেড়শ ফুট উঁচু উঁচু পাহাড়। যেখানে আলো আঁধারির খেলাসহ বৈচিত্র্যময় প্রকৃতি। খুম (দুর্গম একটা স্থান) পার হওয়ার পরে আপনি অল্প পানিতে হেঁটে যাবেন, দু’পাশের পাথুরে দেয়াল বেয়ে আপনার গায়ে টুপটাপ পানির ফোঁটা পড়ছে, এখানে ভুতুড়ে নির্জনতা, একটু পরপর সূর্য আলো ছায়ার খেলা খেলছে। দুর্গম ভুতুড়ে এই স্থানে যেতেই কিন্তু রয়েছে প্রাণনাশের হুমকি। খুমের মধ্য দিয়ে হেঁটে এবং সাঁতরে অথবা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ পাথুরে পাহাড় বেয়ে নেমে যেতে হয়। সাঁতার না জানলে খুমের পানিতে নামলে সেখানে কোনো কোনো ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে তলিয়ে যাবারও সম্ভাবনা থাকে। আর যদি পাহাড় বেয়ে নামেন, তাহলে অবশ্যই দড়ি নিয়ে যেতে হবে। তাও সেই দড়ি যথাযথ স্থানে আটকানোর জন্য প্রয়োজন যথাযথ প্রশিক্ষণ। মোটামুটি চার–পাঁচতলা বিল্ডিং সমান উচ্চতার দড়ি বেয়ে
আপনাকে নামতে হবে। এজন্য খুমে সাঁতার কেটে যাওয়াটা সহজ। ঘোরাঘুরি আর অ্যাডভেঞ্চারের নেশা রয়েছে এমন তরুণদের কাছে মেলখুম যেন এক বিশেষ গন্তব্য। এই মেলখুমের পরতে পরতে যেন রোমাঞ্চ। কিন্তু যাবার পর যে প্রাণের হুমকি তা আর ভাবে না তরুণ পর্যটকরা।
বার বার প্রাণহানির পর নিষিদ্ধ মেলখুম : ২০২৩ সালে মেলখুম গিরিপথে কয়েকজন পর্যটক পথ হারিয়ে ফেলেন। দুই দফায় হারিয়ে যাওয়া কয়েক জন হতাহত হবার পর পর্যটকদের বার বার উদ্ধার করে আনে ফায়ার সার্ভিস ও জোরারগঞ্জ থানা পুলিশ। ২০২৩ সালের ১৫ জুন থেকে সেখানে বন বিভাগ পর্যটক নিষেধাজ্ঞা সংবলিত সতর্কীকরণ ব্যানার ও পেস্টুন টাঙ্গিয়ে দেয়। বন বিভাগের কর্মকর্তারা পর্যটকদের গিরিপথে যেতে
নিষেধ করেন। এরপরও কেউ কেউ অন্য সড়ক ব্যবহার করে মেলখুম গিরিপথে পৌঁছাচ্ছেন। গত বুধবার (৯ জুলাই) সেখান থেকে উদ্ধার করা হলো দুই শিক্ষার্থী বন্ধুর মৃতদেহ। এছাড়া আহত ও হয় অপর বন্ধু সহ ৩ জন। আহত হয়ে জীবিত ফিরে আসা ৩ বন্ধুর চোখে মুখে ছিল ভয় ও আতংকের ভয়াবহ চিত্র।
এই বিষয়ে চট্টগ্রাম উত্তর বন বিভাগের সহকারী বন সংরক্ষক হারুন অর রশিদ বলেন, এই মেলখুম ট্রেল এলাকাটি এতোটাই ঝুঁকিপূর্ণ যে আমাদের বনকর্মীরাও সেখানে যেতে ভয় পান। কিন্তু এই তরুণরা অতি উৎসাহী হয়ে দুঃসাহস দেখাতে গিয়ে প্রাণ হারাচ্ছে। এমন ঝুঁকির জন্যই আমরা এই পথে না যাবার জন্য নোটিশসহ সাইনবোর্ড টাঙ্গিয়ে দিয়েছি। এছাড়া বিভিন্ন সময় প্রচারণাও করছি। কিন্তু সবসময়ের জন্য সকল পথে তো আর পাহারাদার বসিয়ে রাখা সম্ভব না। তাই পারিবারিক সচেতনতা ছাড়া আপাতত কোনো উপায় নেই। এই বিষয়ে মীরসরাই কলেজের অধ্যক্ষ রেজাউল করিম বলেন, তরুণরা সাধারণত অ্যাডভেঞ্চার প্রিয় হয়ে থাকে। প্রকৃতি প্রেমিকদের মনে এমন উৎসাহ একটু বেশিমাত্রায় লক্ষ্য করা যায়। তাই এমন অতি উৎসাহী তরুণদের জন্য পাহাড়ি ট্রেইল ভ্রমণের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন প্রয়োজন। অন্তত এমন স্থানে যেতে যেন প্রশিক্ষণ নিয়ে যাবার ব্যবস্থা থাকে। এই বিষয়ে স্থানীয় সমাজ উন্নয়ন সংস্থা অপকার নির্বাহী পরিচালক মো. আলমগীর বলেন, পাহাড়ি ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে ভ্রমণের জন্য সাধারণত ওজন বহন করে উপরে ওঠা, সিঁড়ি বিহীন উপরে ওঠা, রোপ টেকনিক, নট বাঁধা এবং সুরক্ষা সরঞ্জামসহ এবং প্রাথমিক চিকিৎসার বিশেষ ট্রেনিং থাকা বেশি প্রয়োজন। আবার সাঁতারসহ বিভিন্ন ধরনের শারীরিক ব্যায়ামের মাধ্যমে তাদের স্ট্যামিনা, শক্তি এবং সহনশীলতার প্রশিক্ষণ প্রয়োজন। নচেৎ এমন ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ে গমন না করাই উচিত।
এই বিষয়ে মীরসরাইয়ের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সোমাইয়া আক্তার বলেন, যেহেতু কোনো প্রকার প্রশিক্ষণ বা ঝুঁকি এড়ানোর বিকল্প কোনো উপায় নেই, তাই সেখানে না যেতে বন বিভাগ নিরুৎসাহিতও করছে। এক্ষেত্রে স্ব স্ব অবস্থান থেকে সকলের সচেতনতা বৃদ্ধি ছাড়া এমন মৃত্যুফাঁদ থেকে রক্ষার কোনো উপায় আপাতত দেখছি না।
ঝর্ণাগুলোর ঢাল ও ঝুঁকিপূর্ণ : বর্ষা মৌসুমে মীরসরাইয়ের খৈয়াছরা, রুপসী, নাপিত্তাছরা ও বোয়ালিয়া ঝর্ণায় মানুষের জোয়ার নামে যেন। কিন্তু এসময় শ্যাওলাযুক্ত পাথরগুলো অনেক বেশি পিচ্ছিল হয়ে যায়। তবে বর্ষায় পানির স্তর অনেক বেড়ে যায় বলে ঝর্ণাগুলো দেখতে ভারি সুন্দর দেখায়। মূল ঝর্ণাস্থলে যাওয়ার রাস্তার অধিকাংশই গিরিপথ। তাই অনেক সময় দেখা যায় ঝর্ণায় পৌঁছানোর সেই পুরো ঝিরিপথটাই হাঁটু সমান পানিতে ডুবে থাকে। লাঠি নিয়ে যেতে হয় ঝর্ণায়। আবার ভারী বর্ষণে পানি বেড়ে কোমর পরিমাণ হয়ে যায়। পথগুলো হয়ে যায় পর্যটক চলাচলে ঝুঁকিপূর্ণ। এ ছাড়া ঝর্ণার দৃশ্য দেখতে চূড়ায় ওঠার সময় পা পিছলে কূপে পাথরের ওপর পড়ে অথবা কূপের পানিতে ডুবে হতাহতের ঘটনা ঘটছে। সাঁতার না জানাও পর্যটক হতাহতের অন্যতম কারণ। কয়েক বছরে প্রাণ হারিয়েছে অনেক কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী এবং কর্মজীবীও। বর্ষায় প্রাণ ফিরে পায় মীরসরাইয়ের ঝর্ণাগুলো, ঝর্ণা বয়ে যাওয়ার ছন্দে আনন্দে মাতোয়ারা হয়ে যান পর্যটকরা। আর পর্যটক বাড়ার সাথে সাথে বাড়ে দুর্ঘটনা, ঘটে প্রাণহানি। দুর্ঘটনা এড়াতে পর্যটকরা কিছু নির্দেশনা অনুসরণ করলে দুর্ঘটনা এড়াতে পারেন। ঝর্ণাগুলোর প্রবেশপথে টিকিট কাউন্টারে ইজারাদার ও বন বিভাগ অনুমোদিত গাইড পাওয়া যায়, খরচ হয় ৪–৫ শত টাকা। গাইডরাই পাহাড়ি পথে দুর্ঘটনা এড়িয়ে পথ চলতে সহায়তা করেন এবং নিরাপদে থাকতে পরামর্শ দেন।
ঝর্ণার গভীর কূপ : মেলকুমের পাশাপাশি মীরসরাইয়ের ঝর্ণাগুলোতেও রয়েছে অনেক মৃত্যুকূপ। এসব কূপ কলসি আকৃতির। ওপরে ছোট মুখ আর ভেতরটা বড় ও গভীর। এসব কূপে না নামাই উত্তম। সাঁতার না জানলে তার আশেপাশে না যাওয়াই নিরাপদ। নচেৎ সুন্দরের মোহে প্রাণ যেতে পারে যে কোনো সময়।